ভূমিকা
‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি– নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।” – সুকান্ত ভট্টাচার্য।
অগ্রজ কবির প্রতিটি বর্ণ মনে মনে মন্ত্রের মতো জপ করেছেন যিনি, তাঁর কাজেই তার ফল আমরা পেয়েছি বার বার। অমৃতের এই অধিকারী তাঁর ত্যাগ,তিতিক্ষা অধ্যবসায় দিয়ে আমাদের কাছে উদাহরণ রূপে জাজ্জ্বল্যমান থাকবেন চিরকাল। কাজের প্রতি ও মানুষের প্রতি তাঁর সততা, শ্রদ্ধা আমাদের মাথা নত করে দেয়, তাঁর পায়ে।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
১৯৩১ সালের ১৫ ই অক্টোবর তামিলনাড়ুর রামেশ্বরমে এক মৎস্যজীবী পরিবারে কালামের জন্ম। তাঁর পুরো নাম হল আব্দুল পাকির জৈনুল-আবেদিন আব্দুল কালাম।পিতা হলেন জৈনুল আবেদিন এবং মাতা আসিয়াম্মা। তাঁদের স্বপ্ন ছিল তাঁদের বাড়ির কাছে যে সমুদ্র, তা ও ছাড়িয়ে যাবে তাঁদের এই সন্তান। সাত ভাই বোনের মধ্যে ইনিই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ।
বাল্যকাল ও ছাত্র জীবন
বালক কামাল ছোটবেলা থেকেই যেকোনো কাজের প্রতি অনুরাগ ও একাগ্রতা দেখাতেন। ছোটবেলায়, তাঁর বাবা নৌকা চালাতেন ও তিনিও সাহায্য করতেন। এক সময় খবরের কাগজ বিক্রি করেছেন। চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়েছেন। কিন্তু পড়ার জেদ এবং স্বপ্ন কখনো ছাড়েন নি। বিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে একটি বৃত্তি নিয়ে তিনি ভর্তি হন তিরুচিরাপল্লীর সেন্ট জোসেফ কলেজে। পদার্থবিদ্যায় স্নাতক হন ১৯৫৪ সালে। এরপর পুনরায় বৃত্তি নিয়ে হাজার ১৯৫৫ সালে চেন্নাইতে পড়তে যান। এয়ারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং। তাঁর স্বপ্ন ছিল ভারতের বায়ু সেনার বিমানচালক হবেন। যদিও তা সফল হয়নি। ভারতের ‘মিসাইল ম্যান’ হলেন দেশের এক নম্বর নাগরিক। বিশ্বসেরা এই পরমাণু বিজ্ঞানী এসে দাঁড়ালেন বিশ্বের বড় বড় বিজ্ঞানীদের সমাসনে। ভারত উজ্জ্বলতর হয়ে উঠল তার কীর্তিতে।
কর্মজীবন
১৯৬৯ সালে যোগদান করেন ইসরোতে। পেশা হিসাবে বাছলেন ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগকেও বৈজ্ঞানিক পদে যোগ দিলেন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও ছিলেন বেশ কিছুদিন। যদিও তাঁর জীবনে সর্বোচ্চ খ্যাতি এনে দিয়েছে – অগ্নি ও পৃথ্বী মিসাইল প্রকল্পে অংশগ্রহণ। মহাকাশযান ও স্যাটেলাইট বহনকারী PSLV এবং SLV-III রকেট তৈরিতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। এই কাজে সাফল্যের জন্যই তিনি আজ আমাদের ‘মিসাইল ম্যান’ তিনি নির্মাণ করেছেন – ব্যালিস্টিক মিসাইল ও উৎক্ষেপনের উপযোগী পরিকাঠামো। ১৯৯৮ সালে ভারতের পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষার জন্য ‘পোখরান টু ‘ প্রকল্পের প্রধান প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর নিযুক্ত হন তিনি। ২০০২-২০০৭ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের একাদশ রাষ্ট্রপতির গুরু দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে দেশবাসীর শ্রদ্ধাভাজন হয়ে ওঠেন।
সম্মান প্রাপ্তি
কোন ক্ষুদ্র পুরস্কার বা সম্মানে তাঁকে বেঁধে রাখা যায় না। তবুও তাঁকে পুরস্কৃত করে আমরাই যেন শান্তি পাই বার বার। তেমনি কিছু ভারত ও তার বাইরে প্রায় চল্লিশটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট উপাধি দিয়েছে। পেয়েছেন ‘পদ্মভূষণ'(১৯৮১), ‘পদ্মবিভূষণ'(১৯৯০), ‘ভারতরত্ন'(১৯৯৭), এছাড়াও ভারত সরকার ‘বীর সাভারকর’ পুরস্কার দিয়েছেন তাঁকে। ২০০২ সালে পেয়েছেন ‘রামানুজ পুরস্কার’, এ ছাড়াও বহু সময়ে বহু পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন তিনি।
সৃষ্টিসম্ভার
সৃষ্টির মধ্যেই অমরত্বের বীজ বপন করা থাকে, আর তার যোগ্য উত্তরসূরি হলেন কালাম। তিনি বহু মূল্যবান গ্রন্থের রচয়িতা। তাঁর আত্মজীবনী হলো ‘উইংস অফ ফায়ার'(১৯৯৯)। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ গুলি হল – ইন্ডিয়া টু থাউজেন্স টুইয়েন্টি(১৯৯৮), ইগনিটেড মাইন্ডস,(২০০২), মিশন ইন্ডিয়া(২০০৫), ইনডমিটেবল স্পিরিট(২০০২), ইন্সপায়ারিং থটস(২০০৭) ইত্যাদি।
আমাদের অনুপ্রেরণায় কালামের বক্তব্য
তিনি বারবার অধ্যবসায়, সততা, নিষ্ঠা, তিতিক্ষার কথা বলেছেন। বারবার আমাদের মনোযোগকে কেন্দ্রীভূত করতে বলেছেন নিজের কাজে। বলেছেন পরিশ্রমী হতে। তিনি একথাও বলে গেছেন –‘ আমার মৃত্যুতে ছুটি ঘোষণা কোরো না। আমায় যদি ভালোবাসো, মন দিয়ে কাজ করো সেদিন।’ তিনি এমন প্রশ্ন দেখতে বলেছেন যা আমাদের তাড়িয়ে বেড়াবে।
উপসংহার
‘Work is worship’- একথা নিজের কাজের মধ্যে দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন এই মহামানব। সমস্ত বিলাসিতা বর্জিত, পরিশ্রমী ও সৎ এই মানুষটি নিজের কাজের মধ্যে দিয়েই, ফুলের মতো ঝরে পড়লেন জীবন বৃন্ত থেকে, ২৭ শে জুলাই ২০১৫ সালে। চিরকালের জন্য হারালাম তাঁকে কিন্তু সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে চির জাগরুক রইল তাঁর সত্তা।