ভূমিকা
শৃঙ্খলা ছাড়া বিশ্বজগৎ ছন্নছাড়া। সূর্য চন্দ্র তারকা মন্ডলীর সৌর সংসার সহ সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আবর্তিত হচ্ছে এক সুষম ছন্দ নিষ্ঠায়। নির্দিষ্ট পথে, নির্দিষ্ট সময়ে, গাধা যথা নির্দিষ্ট কর্মপন্থায় সুনির্দিষ্ট আবর্তন এর জন্যেই দিনের পর রাত্রি , গ্রীষ্মের পর বর্ষা, সাজ বদল করে ধরিত্রী জোয়ার-ভাটা খেলে সাগর নদীর জলে। এই শৃঙ্খলা যদি বিপর্যস্ত হয় তাহলে মহাপ্রলয় অবশ্যম্ভাবী। শৃঙ্খলা তাই অবশ্যপালনীয়। কি বিশ্বপ্রকৃতির ক্ষেত্রে ,কী মানুষের ক্ষেত্রে, কী ছাত্রজীবনে– এর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অপরিসীম।
ছাত্র জীবনে ও শৃঙ্খলা
শৃঙ্খলা ও নিয়ম নিষ্ঠা ছাড়া বিজ্ঞান, সাহিত্য শিল্পকলা প্রভৃতি ক্ষেত্রে যেমন কোন কীর্তি অর্জন করা যায় না, তেমনি কোন জাতি ও শক্তিশালী আর্থিক সঙ্গতি তে ও সভ্যতা সংস্কৃতির সম্পদে সমৃদ্ধ হতে পারে না। মানুষের জীবন পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবন এই তিনটি ক্ষেত্রে বিস্তৃত। সমস্ত ক্ষেত্রেই তাকে কতকগুলো নিয়ম, আচরণবিধি সামাজিক ও জাতীয় মূল্যবোধ ইত্যাদি মেনে চলতে হয়। অবশ্য যুগে যুগে ও দেশে দেশে তাদের রূপ বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে তাদের পরিবর্তন ঘটে। অতীতে প্রাচীন ও মধ্যযুগের ব্যক্তির পক্ষে এই সমস্ত নিয়ম বা জীবনাচরণের শৃঙ্খলা পালন ছিল আবশ্যিক, ধর্মীয় শাস্ত্র নির্দিষ্ট।
আমাদের দেশে অতীতকালের জন্মসূত্রে জাতি বর্ণ ব্যবস্থা অনুযায়ী একটি ব্যক্তির জীবিকা, জীবনযাত্রা, জাতিত্ব ইত্যাদি সমস্ত কিছু নির্ধারণ করা হতো। আধুনিক সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যক্তি কে ব্যক্তিগত রুচি যোগ্যতা ও প্রবণতা অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণ, জীবিকা নির্বাচন, জীবনযাত্রা পদ্ধতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ স্বাধীনতা দেয়, ব্যক্তিকে ও তেমনি রাষ্ট্রের লিখিত শাসনতন্ত্র বা নিয়মবিধি এবং সমাজের অলিখিত নিয়ম মেনে চলতে হয়, তাকেই এই সত্য উপলব্ধি করতে হয় যে সমষ্টিগত বা জাতীয় স্বার্থ রক্ষার সর্বজনীন বিধি নিয়ম পালন না করলে তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে। সমাজ বা রাষ্ট্র এবং ব্যক্তির পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সহযোগিতার ওপর যে দেশের সমাজ জীবনের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, সেই দেশ তত উন্নত ও শক্তিশালী। শৃঙ্খলা সেখানে বন্ধন নয়, জাতীয় জীবনের অগ্রগতির, সভ্যতা সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে নব নব নির্মাণ ও সৃষ্টির অবলম্বন।
এই আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, প্রতিটি দেশের জাতীয় জীবনে শৃঙ্খলা স্থান কত গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপের উন্নত জাতিগুলি শৃঙ্খলা ও নিয়ম নিষ্ঠার ভিত্তিতেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যাকে আয়ত্ত করে শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত হয়েছে। প্রাচীন যুগে গ্রিক ও রোমান জাতি সামরিক শক্তিতে, সভ্যতা-সংস্কৃতির সমস্ত ক্ষেত্রে যে নেতৃস্থানীয় ছিল তার অন্যতম প্রধান কারণ, সমাজের সর্বস্তরে ব্যাপ্ত শৃঙ্খলা বোধ। রাষ্ট্রের প্রধান থেকে আরম্ভ করে সাধারণ কর্মচারী পর্যন্ত প্রত্যেক এই নির্দিষ্ট কর্তব্য ও দায়িত্ব আছে, তাদের তা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে হয়, তবেই তার অগ্রগতি অব্যাহত থাকে।
ব্রিটিশ জাতি ক্ষুদ্র দ্বীপপুঞ্জের সামান্য কয়েক কোটি অধিবাসীদের নিয়ে গঠিত কিন্তু শৃংখলার ভিত্তিতেই তারা এক সময়ে বিশ্বব্যাপী বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল, দীর্ঘকাল আফ্রিকা এশিয়ার দেশ গুলিকে নিজেদের শাসন শৃঙ্খলিত করে রাখতে পেরেছিল। রাশিয়া জাপান ঊনবিংশ শতাব্দীতে অন্তত অনগ্রসর দেশ ছিল, চীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের কালেও ছিল পশ্চাত্পদ, এই সমস্ত দেশ জাতীয় স্বার্থের শৃঙ্খলা বোধে অনুপ্রাণিত হয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সামাজিক ও জাতীয় জীবনে শৃঙ্খলা রক্ষার উপরই জাতীয় সংহতি নির্ভরশীল। তার অভাব এই আমাদের দেশ স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছিল।
বর্তমান পরিবেশে ছাত্র জীবনে শৃঙ্খলার প্রয়োজনীয়তা
ছাত্ররা দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক, জাতির ভবিষ্যৎ তাদের উপর নির্ভরশীল। স্বভাবতই ছাত্র জীবনে শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এটাই ভবিষ্যৎ জীবনের ভিত্তি নির্মাণের সময়। ছাত্রজীবনে গুরুতর ত্রুটি-বিচ্যুতি শৈথিল্য ঘটলে দূর পনেয় কলঙ্ক গ্লানিতে নিমজ্জিত হয়ে পদে পদে লজ্জিত হতে হবে আজীবন। মেধা যতই থাকুক, সময় জ্ঞান, ঠিক সময়ে ঠিক কাজটি সুষ্ঠুভাবে করা, প্রাত্যহিক জীবনাচরণে নিয়মানুবর্তিতা, প্রতিদিনের কর্মসূচি স্থির করে নিয়ে তার অনুসরণ, কর্তব্যনিষ্ঠা, এককথায় জীবনে শৃঙ্খলা না থাকলে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব নয়। আলস্য, দীর্ঘসূত্রতা ও শৈথিল্য আমাদের রক্তে মজ্জাগত, এই সমস্ত দোষ উদ্যম ও কর্মশক্তিকে ক্রমাগত ঘুণ ধরিয়ে নষ্ট করে দেয়, আমরা কর্মবিমুখ হয়ে পড়ি।
তারপর নিজেদের অক্ষমতার নানা অজুহাত, কৈফিয়ৎ তৈরি করি, অপরকে এবং নিজেদের পরিবেশকে দায়ী করি এবং শরীর-মনের জড়তার আচ্ছন্ন হয়ে নিজেদের দোষ ত্রুটি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অচেতন থাকি। তখন সর্বনাশ যা হবার হয়ে যায়। সুতরাং ছাত্রদের সমস্তই হৃদয়-মন দিয়ে শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা যে কতখানি তা উপলব্ধি করতে হবে। তারা ভবিষ্যতে যে কোন বৃত্তি গ্রহণ করুক, তার জন্য উপযুক্ত হয়ে নিজের পরিবার, সমাজ ও দেশকে কিছু দিয়ে, তাদের সেবা করে মনুষ্য জন্মকে সার্থক করতে হবে, শৃঙ্খলা পরায়ন হতে হবে। শৃংখলার মধ্যে দিয়েই মানুষের ব্যক্তিত্ব বা চরিত্র গঠিত হয়। বস্তুত ছাত্রজীবনে তথা ব্রহ্মচর্য জীবনে কঠিন শৃঙ্খলা পালনের শক্তি ভবিষ্যৎ জীবনে দুঃখ জয়ের প্রতিষ্ঠা এবং শান্তি স্থাপনের দীক্ষা ও প্রেরণা।
বর্তমানে ভারতবর্ষের সমাজ জীবনের নানা ক্ষেত্রে উচ্ছৃংখলতা ভয়াবহ সংক্রামক ব্যাধির মতো ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে চূড়ান্ত অবহেলা অন্যদিকে সুযোগ সুবিধা লাভের জন্য তৎপরতা, ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থে সমাজ বিধি লঙ্ঘন ও জাতীয় স্বার্থকে আঘাত করে যথেচ্ছাচার, সামান্য তুচ্ছ কারণে হাঙ্গামা বাদিয়ে তুলে এবং উচ্ছৃঙ্খল আচরণে সমাজের ও দেশের গুরুতর ক্ষতিসাধন ইত্যাদি প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দায়িত্ব বোধ হীনতা ও উচ্ছৃঙ্খলতার ব্যাধি ছাত্রদের মধ্যেও সংক্রামিত। ছাত্রদের ধারণা, পরীক্ষা গৃহে অসাধু উপায় অবলম্বন তাদের জন্মগত অধিকার, আক্রোশে চেয়ার টেবিল ভাঙা, শ্রদ্ধেয়দের অপমানিত ও লাঞ্ছিত করা পৌরুষের কাজ। এইভাবে প্রবঞ্চনার আশ্রয় নিয়ে জীবনে কোনদিনই প্রতিষ্ঠা লাভ করা যায় না। বিদ্যালয়ের পরীক্ষার থেকেও জীবনে আরও বড় ও কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। কঠিন পরিশ্রমে, ধৈর্যে ও নিষ্ঠায়, শৃংখলার মধ্যে দিয়েই জীবনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়।
উপসংহার
ছাত্রদের অভাব-অভিযোগের যে কোনো কারণ নেই তা নয়। তার প্রতিকার পেতে হলে তাদের আন্দোলন সুশৃংখল হওয়া দরকার। সামাজিক অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে যথার্থ সংগ্রামের ভিত্তি ও শৃঙ্খলা পরায়নতা কর্তব্য নিষ্ঠা ও দায়িত্ববোধ। উচ্ছৃংখল মানুষেরা কখনো কোন জাতীয় সংগ্রামের সৈনিক হতে পারে না। বিভিন্ন দেশের বৈপ্লবিক বা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস তারই সাক্ষ্য দেয়। যে উচ্ছৃংখল, সে সমাজের নৈতিক দুর্গতি কে আরও বাড়িয়ে দেয় এবং তার দাসে পরিণত হয়, তার সমস্ত শক্তির অপচয় ঘটে। শৃঙ্খলা পরায়ণতাই সকল রকমের জীবন-সংগ্রামের উৎস, ছাত্র সমাজকে সব সময়েই এ কথা মনে রাখতে হবে।