ভূমিকা
যে যুগে মানুষের বৈজ্ঞানিক মনীষা পৃথিবীর সীমা অতিক্রম করে মহাকাশ পরিক্রমায় রত সে যুগে প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞানের প্রভাব যে কত ব্যাপক ও বিচিত্র তার সুনির্দিষ্ট বিবরণ দেওয়া প্রায় দুঃসাধ্য। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে পৌঁছে মনে হচ্ছে বিজ্ঞানের রাজ্যে অসার বলে কিছু নেই। এতদিন জানা ছিল মাধ্যাকর্ষণের সীমা অতিক্রম করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তাও সম্ভব হয়েছে। গবেষণাগারের টেস্ট টিউবে প্রাণস্পন্দন ও সম্ভব হয়েছে। অতএব মানুষের বিস্ময় ও আর কুল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছেনা। বিজ্ঞানের প্রসাদে শুধু মানুষের ব্যবহারিক জীবন নয়, অন্তর্লোকেও এসেছে বিরাট পরিবর্তন। প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞানের যে শাখার বহুবিচিত্র প্রয়োগ ঘটে চলেছে তা হলো প্রযুক্তি বিজ্ঞান ।
সভ্যতার বিবর্তন ও বিজ্ঞান
মানুষ যেদিন আগুন ও লোহার ব্যবহার শিখল সেদিন থেকেই প্রায়োগিক বিজ্ঞানের যাত্রা শুরু। আদিম নরগোষ্ঠী ও তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সরল ওস্থূলতার প্রযুক্তি বিজ্ঞানের সহায়তা গ্রহণ করত। বলা হয় necessity is the mother of invention– প্রয়োজনীয় আবিষ্ক্রিয়ার প্রসূতি। সেই সূত্রেই চক্র থেকে রকেট উৎক্ষেপণ প্রয়োজনের তাগিদেই মানুষ প্রাকৃতিক শক্তিকে যন্ত্র চালনায় নিয়োগ করেছে। সময় ও শ্রম লাঘবের সচেতন প্রয়াসেই দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের প্রয়োগ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক কালে বিজ্ঞানের উন্নততর গবেষণার ফলে মানব মস্তিষ্কের বিকল্প স্থান গ্রহণ করেছে কম্পিউটার বা যন্ত্র গণক।
প্রাচীন যুগে বিজ্ঞানের ব্যবহার
বুদ্ধিমান মানুষ সুপ্রাচীন কাল থেকেই শ্রম লাঘব ও গতি বৃদ্ধির চেষ্টায় রত রয়েছে। প্রাচীনকালে যেসব বৈজ্ঞানিক সামগ্রী মানুষ কাজে লাগাতে শিখেছে সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল চাকা, কপিকল, জলঘড়ি, আবাকাস নামক গণক যন্ত্র। প্রাচীন মানুষই প্যাপিরাস থেকে তৈরি করে সভ্যতার অপরিহার্য উপাদান কাগজ। প্রাচীন ভারত আবিষ্কার করে সংখ্যাও শূন্য এবং মাপজোখ। ওজন পরিমাণ মিশরীয় সভ্যতার দান। প্রাচীন গ্রীকজাতি প্রাণিবিদ্যা, স্থাপত্যবিদ্যা ও জ্যামিতিকে ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ এর পথিকৃৎ। অন্যদিকে বীজ গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, মানুষের জীবনে আনে স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তা। প্রাচীন যুগেই মানুষ বায়ু শক্তিকে কাজে লাগিয়ে শ্রম লাঘবের চেষ্টা করেছে। আবিষ্কৃত হয়েছে ‘ওয়াটার মিল’ ও ‘উইণ্ডমিল’ প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তি পরিচালিত যন্ত্র।
গার্হস্থ্য জীবনে বিজ্ঞান
আধুনিক গৃহিনীর জীবনে এখন কতকগুলি যান্ত্রিক সরঞ্জাম অপরিহার্য বলে বিবেচিত হচ্ছে। রান্না ঘরে থাকবে গ্যাস সিলিন্ডার ও ওভেন,মিকসার আরো কত কি। তারপর আহার্যবস্তু ও প্রায় অর্ধেক তৈরি অবস্থায় পাওয়া যায়। সুতরাং এক মিনিট দু- মিনিটে টিফিন প্রস্তুত, এক ঘন্টায় রান্না সমাপ্ত। দৈনিক বাজারের ঝামেলা এড়াবার জন্য ফ্রিজে সঞ্চিত থাকে শাক সবজি, মাছ- মাংস। আছড়ে- পিটিয়ে কে আর কাপড় কেচে গা -হাত পা ব্যথা করে। গৃহকোণে শোভে ওয়াশিং মেশিন। ডাইনিং রুমে বেসিন, বাথরুমে শাওয়ার -ফ্লাশ শহরে জীবনে আর বিলাসিতা নয়, অপরিহার্য।
প্রাত্যহিক জীবনে বৈজ্ঞানিক যোগাযোগ ব্যবস্থা
টেলিফোন টেলিগ্রামে যোগাযোগ এখন প্রায় সেকেলে ব্যবস্থা। মোবাইল ফোন, টেলিপ্রিন্টার, পেজার প্রভৃতিতে তাৎক্ষণিক সংযোগ সাধন আজকের যুগে অত্যন্ত জরুরী। তদুপরি আছে বেতার মাধ্যমে প্রেরিত বার্তা রেডিওগ্রাম। যানবাহনের মাধ্যম ট্রাম-বাস- মোটর। সময় সাশ্রয় ও আরামপ্রদ যাতায়াতের জন্য পাতাল রেল। সম্পূর্ণ সচ্ছল দের জন্য বিমান বন্দরে প্রস্তুত জেট প্লেন, শব্দেরচেয়ে দ্রুতগামী বিমান সপারসনিক জেট। স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ আজকাল পৃথিবীর দূরতম প্রান্তের সঙ্গে যোগাযোগ সহজতর করে তুলেছে।
চিকিৎসায় বিজ্ঞান
আজকাল রোগ নির্ণয়ের ডাক্তারবাবুরা শুধু স্টেথো ও থার্মোমিটার এর উপর নির্ভর করেন না। ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের শক্তি ও অনুমানের চেয়ে শতগুণে নির্ভরযোগ্য ইলেক্ট্রো-কার্ডিও-গ্রাম, আলট্রা সনোগ্রাফি, প্রভৃতি বৈদ্যুতিক রোগ -নির্ণয় পদ্ধতি। ভিডিও স্কিনে ফুটে ওঠে দেহাভ্যন্তরের জটিল ক্রিয়া প্রণালীর ছবি। শল্য চিকিৎসায় যুগান্ত এনেছে লেসার- সার্জারি, মাইক্রো-সার্জারি প্রভৃতি। সেই সঙ্গে প্রচলিত রয়েছে সনাতন একস-রে, অণুবীক্ষণ যন্ত্রও।
কৃষি ক্ষেত্রে বিজ্ঞান
উচ্চ ফলনশীল বীজ,রাসায়নিক সার,কীটনাশক এবং অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কার হওয়ার ফলে কৃষি ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এসেছে বিজ্ঞানের দ্বারা।যার ফলস্বরূপ উদাহরণ হল সবুজ বিপ্লব।
শিল্প ক্ষেত্রে বিজ্ঞান
শিল্পের আঙ্গিনায় বিজ্ঞানের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে।শিল্প-কলকারখানা উন্নত মানের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে কম খরচে বেশি পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে।
ষোড়শ শতকে ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের ফলে দৈনন্দিন জীবনযাপন প্রণালীতে এল ব্যাপক পরিবর্তন। একদিকে যেমন যন্ত্রচালিত কল কারখানায় শ্রমিকেরা অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ে অধিক উৎপাদনে সক্ষম হল অন্যদিকে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য নানা প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী জীবনকে করে তুলল পূর্বের তুলনায় স্বচ্ছন্দ। এই সময়ে আবিষ্কৃত হয় বাষ্পীয় ইঞ্জিন এবং অল্পকাল পরে বৈদ্যুতিক শক্তি,খনিজ জ্বালানির ব্যবহার শুরু হয়। ইউরোপ থেকে যন্ত্রশিল্প সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে বিজ্ঞানকে প্রাত্যহিক জীবনে অপরিহার্য করে তুলল।
বিজ্ঞান ও মানব সভ্যতা ( Science and Human Civilization)
প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞানের সর্বব্যাপ্ত উপযোগিতা
এ তো গেল সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞানের প্রভাব এর কথা। এ যুগে তো চাষী ভাইরা জলসেচ, রাসায়নিক সার, উপগ্রহ প্রেরিত ঝড় -জলের আগাম বার্তা দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গীভূত করে নিয়েছে। আরো যে কত ব্যাপারে বিজ্ঞানের সাহায্য নিতে হয় তার সীমা সংখ্যা নেই। পীড়িতের চিকিৎসায়, আর্তের সেবায়, প্রমোদ-পিয়াসীর আনন্দ উপকরণ সরবরাহে, প্রতিরক্ষার আর বিজ্ঞান ছাড়া গত্যন্তর নেই। রাষ্ট্রের কর্ণধারগণ ও কোটিপতি ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে দ্রুতগামী বিমানে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ছোটাছুটি করে বেড়ান। দুরারোগ্য রোগ নিরাময়ে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি এনেছে অভাবনীয় সাফল্য। সিনেমা ও মঞ্চে যন্ত্রই রচনা করে আলো ছায়া মায়া এ কথায় এতোটুকু অত্যুক্তি নেই যে, বিজ্ঞান বর্তমান যুগের মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সত্যই অশেষ কল্যাণ এনেছে।
মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান চর্চা (Teaching through Mother Language)
উপসংহার
তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের অনুশীলনে মানুষ বৌদ্ধিক আনন্দ অনুভব করে। প্রযুক্তি বিজ্ঞানের ব্যবহার তাকে দেয় জৈবিক স্বচ্ছন্দ ও ব্যবহারিক জীবনের নানা জৈবিক বিশুদ্ধ বিজ্ঞান। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যা পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক আবিক্রিয়া গুলি যেমন –কৃত্রিম প্রজনন বিজ্ঞান, অটোমেশন প্রভৃতি আমাদের জীবনকে সম্পূর্ণ নতুন পথে পরিচালিত করছে। নানা প্রকার জীবনদায়ী ওষুধ চিকিৎসা বিজ্ঞানে আশ্চর্য উন্নতির মানুষের গড় আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষের দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে অনুকূল নয়। উপযুক্ত কায়িক শ্রমের অভাবে দেহ যন্ত্র বিকল হয়ে পড়ে, শরীরে মেদ জমে এবং সেই সঙ্গে কর্মহীনতা মনকে বৈচিত্র্যহীনতায় ও ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন করে। তাই শহরের একজন মেদ-মৈনাক কে ময়দানে লিপ্ত হতে দেখা যায়, প্রাতঃ ভ্রমণকারীদের সংখ্যা নিয়ত বেড়েই চলেছে। বিজ্ঞানের উন্নতি আমাদের সামাজিক ধ্যান-ধারণা মূল্যবোধের দ্রুত পরিবর্তন ঘটাচ্ছে।’ কাজেই বিজ্ঞানীকে তাঁর সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে এবং সাধারণ মানুষকেও অতিরিক্ত যন্ত্র নির্ভরতা এড়িয়ে চলতে হবে।