ভূমিকা
সংবাদপত্র আধুনিক জীবনযাত্রার অপরিহার্য অঙ্গ। দেশবাসী যতটা সমাজ সচেতন হবে ততই এর কদর এবং দায়িত্ব বৃদ্ধি পাবে। দেশকে, সমাজকে, চেনার জন্যে, উন্নতির ধারাকে জানার জন্যে, সমকালের দর্পণ সংবাদপত্রের ভূমিকা অপরিসীম। বস্তুত লোকশিক্ষা,জনমত গঠনের কাজে সংবাদপত্র নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটায় ।যেকোনো উন্নয়নশীল দেশে তাই সংবাদপত্রের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। দেশ-বিদেশের আধুনিকতম সংবাদ প্রচার করে সংবাদপত্র দেশবাসীকে সম্যকরূপে শিক্ষিত করে তোলে । সেইসঙ্গে মানবসভ্যতার প্রগতি কেও দিগদর্শন করায়। ঊনবিংশ শতকের নবজাগরণের সময় এই দেশ বরন্য মনীষীগণ উপলব্ধি করেছিলেন, শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা কে আশ্রয় করে সমাজ উন্নয়ন সম্ভব নয়। সামাজিকদের শিক্ষিত করতে হলে সর্বপ্রথম সাময়িকপত্র আবশ্যক। তার মাধ্যমে দেশ সমাজ জ্ঞান -বিজ্ঞান- সাহিত্য -কলা সম্বন্ধে রকমারি সংবাদ ও আলোচনা-সমালোচনা প্রকাশ করে মানুষকে লোকশিক্ষা দেবার প্রয়াসী হয়েছিলেন তাঁরা। সংবাদপত্রের ইতিহাসে হিকির ‘বেঙ্গলি গেজেট’ পথিকৃতের সম্মানাধিকারী।
আধুনিক সংবাদপত্রের ভূমিকার বিভিন্ন দিক
সংবাদপত্র আধুনিক সমাজ জীবনকে কত দিক থেকে স্পর্শ ও প্রভাবিত করে তার ইয়ত্তা নেই। ইউরোপের সমাজ বিজ্ঞানীরা বেতার, টেলিভিশন, সিনেমা, সংবাদপত্র ইত্যাদি মাস মিডিয়া বা জনসংযোগের মাধ্যম গুলি নিয়ে নানা সমীক্ষা চালিয়েছেন,তাদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করেছেন। অতীতে গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজে ধর্মযাজক, গুরু পুরোহিত, চারণকবি, গ্রামের বৃদ্ধ ব্যক্তিরা কথক ঠাকুর প্রভৃতি ব্যক্তিরা জনশিক্ষার ভার গ্রহণ করতেন, জনসাধারণের মনে সামাজিক জীবনাচরণে আদর্শ সঞ্চারিত করে দিতেন। বর্তমান যুগে গণসংযোগের মাধ্যমগুলি তাদের সেই ভূমিকা নিয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকায় টেলিভিশন জনপ্রিয়তায় ও প্রভাব বিস্তারে শীর্ষস্থানীয়। ভারতবর্ষে টেলিভিশন প্রবর্তিত হয়েছে তবু এ দেশে সংবাদপত্রের প্রচলনই অপেক্ষাকৃত বেশি।
আমাদের দেশের জনমত গঠনে সংবাদপত্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শাসকদলের যেমন, তেমনি বিরোধী দলের প্রতিনিধিদের বক্তব্য, মতামত সমানভাবে তুলে ধরে তাদের যুক্তি ও তথ্যনিষ্ঠ সমালোচনা প্রকাশ করে সংবাদপত্রগুলি জনসাধারণের বিচারবোধ ও গণতান্ত্রিক চেতনাকে পরিণত করে তুলতে সাহায্য করে । নিষ্ঠার সঙ্গে সেই ভূমিকা পালন করলে সংবাদপত্র হয়ে ওঠে জাতীয় বিবেকের কণ্ঠস্বর, সমাজজীবনের অতন্ত্র প্রহরী । সংবাদপত্রে জনমত প্রতিফলিত হয় বলে শাসক কর্তৃপক্ষ সে বিষয়ে অবহিত হওয়ার সুযোগ পান,তার সমালোচনার আলোয় নিজেদের দোষ ত্রুটি সংশোধন করে নিয়ে দেশ শাসনের নীতি ও কার্যক্রম সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারেন।
সংবাদপত্রের চিঠিপত্র স্তম্ভে প্রকাশিত বিভিন্ন বিষয়ে পাঠক-পাঠিকাদের মতামত জনসাধারণের মত, আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রত্যাশা ইত্যাদির মূল্যবান দিগদর্শন। আমেরিকার বিখ্যাত ভাষ্যকার ওয়াল্টার লিপম্যান এর বিশ্লেষণমূলক নির্বন্ধ যেদিন প্রকাশিত হতো,আমেরিকার প্রেসিডেন্টের মতো প্রভাব-প্রতিপত্তি শালী রাষ্ট্রনায়কেরা প্রথমেই তা পড়তেন। সামাজিক অন্যায়-অবিচারের প্রতিরোধ এবং তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে ও সংবাদপত্র কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ অতিক্রান্ত হওয়ার পরও পণপ্রথা ও জাতি বর্ণভেদ ব্যবস্থায় শিকার হয়ে এদেশের বহু নারী-পুরুষ যে নিষ্ঠুর লাঞ্ছনা উৎপীড়ন ভোগ করে,সংবাদপত্রগুলি তার বিবরণ দিয়ে তার বিরুদ্ধে জনমতকে সংগঠিত করেছে।
আধুনিক যুগের সংবাদপত্র অর্থনৈতিক সমস্যা, বিজ্ঞান, খেলাধুলো, নাটক,সিনেমা, শিল্পকলা, বই ও পত্রপত্রিকা, মেলা ও উৎসব, সাংস্কৃতিক জীবন ইত্যাদি বহু বিষয়ে সমীক্ষা ও সমালোচনা প্রকাশ করে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডারের কাছ থেকে ভারতবর্ষের ঋণ গ্রহণ দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট মোচনে কতটা সহায়ক হবে, অথবা জাতীয় অর্থনৈতিক অবস্থাকে পরিণামে আরো সমস্যা জটিল করে তুলবে, সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ থেকেই আমরা সে বিষয়টি বুঝে নিতে পারি। নাটক, সিনেমা, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে জনসাধারণের রুচি গঠনে সংবাদপত্রের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দেশে সুস্থ, রুচিশীল সাংস্কৃতিক জীবন গড়ে তুলতে সংবাদপত্র যথেষ্ট পরিমাণে সাহায্য করতে পারে। বিচ্ছিন্নতাবাদ অশুভ শক্তি রূপে দেখা দিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এবং জাতীয় সংহতি সাধনে সংবাদপত্র নিঃসন্দেহে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে ।
সংবাদপত্রের ভূমিকা সমালোচনা
কিন্তু বর্তমানের সংবাদপত্র দেশে ও সমাজের কল্যাণ সাধনের সেই মহৎ আদর্শ থেকে অনেকটা পরিমাণেই ভ্রষ্ট হয়েছে। সংবাদপত্রগুলো অধিক লাভ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বাণিজ্যিক সংস্থা রূপে পরিচালিত হয়। বেশ কিছু সংবাদপত্র নগদ নারায়ণের লোভে অস্বাস্থ্যকর উত্তেজনা, কুরুচি ইত্যাদির খোরাক জোগাতে সবসময়ই তৎপর। কোন কোন সংবাদপত্র প্রাদেশিকতা, সাম্প্রদায়িকতা ও আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদে ইন্ধন জোগায়। নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ ভাবে সংবাদ পরিবেশন প্রতিটি সংবাদপত্রের প্রাথমিক দায়িত্ব। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে ঘটনাকে বিকৃত করে, এমনকি কখনও কখনও মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনের মত অসদাচরণের দৃষ্টান্ত ভারতীয় সংবাদপত্রের জগতে দুর্লভ নয়। সমাজের কল্যাণ সাধনের মতো তার ক্ষতি সাধনের ক্ষমতা ও সংবাদপত্রের কম নয়।
উপসংহার
দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, সামাজিক কুপ্রথা, অন্ধ সংস্কার বিশ্বাস প্রভৃতিতে ভারত বর্ষ আজও ভারাক্রান্ত, তার ওপর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিচ্ছিন্নতাকামী শক্তিগুলি সক্রিয়। এই পরিস্থিতিতে সংবাদপত্র গুলির বিশেষ দায়িত্ব আছে। কোন অবস্থাতেই তাদের সামাজিক কল্যাণ বোধের আদর্শ ভুলে যাওয়া উচিত নয়। অন্যদিকে যে দলই দেশের বা রাজ্যের শাসনভার পাক, তাদের সকল সময়ই মনে রাখতে হবে, সংবাদ পত্রই হলো সামাজিক ও রাষ্ট্র জীবনের গণতান্ত্রিক কাঠামোর অন্যতম প্রধান ভিত্তি, তার সমালোচনা সম্পর্কে অসহিষ্ণু হলে চলবে না ।