ভূমিকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার বাইরে সমগ্র ভারত জুড়ে অজগর নিদ্রার মতো পড়ে রয়েছে অশিক্ষা ওঅজ্ঞনতার সূচিভেদ্য অন্ধকার । সেখানে লোকশিক্ষার বাতি নেভানো। অথচ ইংরেজদের আগমনের পূর্বে এদেশে সনাতন শিক্ষার ধারা ছিল বহু শ্রোতা। পঞ্চ বটী ছায়াছন্ন গ্রাম ভারতে সেদিন সার্বজনীন শিক্ষার ছিল অবারিত দ্বার । সেই শিক্ষা আক্ষরিক ছিল না বটে কিন্তু আত্মিক ছিল। কিন্তু ভাগ্যচক্রে নিষ্ঠুর পরিবর্তনে পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রবল আক্রোশে ভারতের সেই বহুস্রোতা সনাতন শিক্ষার ধারা তার নিজস্ব গৌরব সুষমা হারিয়ে হয়ে গেল অবলুপ্ত ।
বিশ্ববিদ্যালয় ও ভারতীয় সনাতন শিক্ষাধারার সংকোচ
ইংরেজ আমলে কেরানি গড়ার জন্যে স্থাপিত হল বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে সর্বসাধারণ নয়, মুষ্টিমেয় ভাগ্যবানেরা প্রবেশাধিকার পায়। তাই একদিকে আমাদের দেশে সনাতন শিক্ষার ব্যপ্তি রুদ্ধ হয়ে জনসাধারণের মধ্যে জ্ঞানের অনাবৃষ্টি চিরকালীন হয়ে দাঁড়ালো, অন্যদিকে আধুনিক কালের নতুন বিদ্যার যে আবির্ভাব হলো, তার প্রবাহ বইলো না সার্বজনীন দেশের অভিমুখে। পাথরে গাঁধা কুন্ডের মত স্থানে স্থানে সে আবদ্ধ হয়ে রইল ।
প্রাচীন ভারতীয় লোকশিক্ষার ধারা বিপর্যয়
অথচ আবহমানকাল কৃষক, মজদুর, শিল্পী শ্রমিকদের জীবনে আনন্দঘন শিক্ষা ছিল অবারিত দ্বার । যাত্রা,কথকথা, ব্রত কথা, ছড়া ও সংকীর্তন এর মাধ্যমে অভিনয়, গান ও আবৃত্তির আঙ্গিকে মানবিকতার সারমর্ম বহু স্রোতা হয়ে প্রবাহিত হয়ে যেত। তারা শুনত ধ্রুব প্রহ্লাদের কথা, সীতার বনবাস, কর্ণের কবচ দান, হরিশচন্দ্রের সর্বস্ব ত্যাগের কাহিনী। পাশ্চাত্য সভ্যতার আক্রমণে আমাদের লোকশিক্ষার সেই আনন্দের হাট গেল ভেঙে।
লোকশিক্ষার বেদনাময় পরিণতি
এল স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি। পল্লীগীতি স্থানে ধ্বনিত হলো স্বদেশী গান। স্বাধীনতা লাভের পর সে ধারা ও এল শুকিয়ে। তারপর এল সিনেমাও দূরদর্শনের যুগ। এই নব্য সংস্কৃতির ভক্ত দল হলো স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী, আপিস- কেরানি ও গৃহবধূর দল। গ্রাম ভারত ও তার আক্রমণ থেকে নিষ্কৃতি পায়নি ।সেখানে গ্রামেগঞ্জে যত্রতত্র গজিয়ে উঠেছে ভিডিও হল । গ্রাম ভারত সেখানে অপসংস্কৃতির পঙ্কিল আবর্তে নিমজ্জমান।
লোকশিক্ষার নব রূপায়ণ প্রয়োজন
ভারতে আজ গণতন্ত্র প্রবর্তিত। পাশ্চাত্যের ঘরে গণতন্ত্রের যে সফল্য তার মূলে রয়েছে সার্বজনীন শিক্ষা,যা গণতন্ত্রের রথ অচল। ভারতে ও গণতন্ত্রের সাফল্যের প্রয়োজন গণমাধ্যমগুলোকে আরো শক্তিশালী করে তোলার প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে।কিন্তু তার প্রয়োগ পদ্ধতি অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় তা বিকৃত রুচির হয়েছে নিয়মিত যোগানদার।
বেতার কার্যসূচি ও প্রাচীন লোকশিক্ষার ধারার আধুনিকরণ
সাম্প্রতিক কালে লোকরঞ্জনী শিক্ষা প্রচারে প্রধান গণমাধ্যম হলো বেতার শিল্প। ১৯৪৭ সালে ভারতে ছিল মাত্র ৬ টি বেতারকেন্দ্র ।এখন ভারতে বেতার-প্রচার কেন্দ্রের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সর্বমোট ২০৮। কথিকা, বেতার রূপক ও নাটক বেতার সুচির প্রধান আকর্ষণ। কথকথা, কবিগান, পাঁচালী গান, পল্লীগীতি এবং যাত্রা আজ আর অবহেলিত নেই । এফ. এম .এর চল্লিশটি আকাশবাণীর চ্যানেলের চল্লিশটি আকাশবাণীর চ্যানেলের মধ্যস্থতায় কৃষি কথার আসর ,ও জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রচারসূচি এখন বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
সংবাদপত্র ও চলচ্চিত্র
গণশিক্ষা ও গণসংযোগের প্রধান বাহন হল সংবাদপত্র। তার সাফল্য দেশের সাক্ষরতার উপর নির্ভরশীল। ভারতে অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার এই বেহাল অবস্থা। ভারতে বর্তমানে সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্র পত্রিকার সংখ্যা৫১,৯৬০। গণশিক্ষা ও জনসংযোগ এর ব্যাপারে চলচ্চিত্রের ভূমিকা অসাধারন। কিন্তু ভারতে গণশিক্ষার ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ একান্তভাবেই নৈরাশ্যজনক । আমাদের দেশের সরকার প্রযোজিন প্রমাণ্য চলচ্চিত্রগুলি তে শিক্ষনীয় কিছু থাকেনা । কাজেই আমাদের দেশের চলচ্চিত্র কেবলমাত্র রুচি বিকৃতি ও বিলাসের সামগ্রী।
দূরদর্শন
ভারতের জাতীয় জীবনে কুরুচি বিস্তারে গণমাধ্যম গুলির মধ্যে সর্বাধুনিক আগন্তুক হলে দূরদর্শন। ১৯৯৭ সালের ২৩ শে নভেম্বর প্রসার ভারতীয় কার্যক্রমে উপগ্রহ চ্যানেল এর সাহায্যে এর প্রচার পরিধি সুদূর ব্যপ্ত হয়ে যায়। আজ ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রাম গঞ্জ এর আওতার মধ্যে চলে এসেছে। বর্তমানে ১০০ টি চ্যানেল প্রচার নিরত। কৃষি ,বিজ্ঞান, শিল্প, শিক্ষা, শিশু- বিকাশ, নারী -মুক্তি, খেলাধুলা, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ের আলোচনা তার প্রচার সূচির অন্তর্গত।
উপসংহার
প্রাচীন ভারতের সনাতন ও সার্বজনীন গণমাধ্যম গুলি আজ লুপ্ত, কিন্তু আশার কথা ,সম্প্রতি গণশিক্ষার প্রতি কর্তৃপক্ষের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়েছে। লোকশিক্ষার ব্যাপক আয়োজন ছাড়া গণতন্ত্রের তরুশিশু তপ্ত মরু নিঃশ্বাসে যাবে শুকিয়ে ,তার বিকাশের সকল সম্ভাবনা হবে অবলুপ্ত। সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি দেয়ার দিন এসেছে।