আমার প্রিয় গ্রন্থ (My Favorite Book)

ভূমিকা:

বাংলা সাহিত্যের বয়স প্রায় হাজার বছর। এই সুদীর্ঘ কালসীমায় এসেছেন কত কবি, কত গল্পকার, কত প্রবন্ধ কার, কত নাট্যকার, কত ঔপন্যাসিক। তাঁদের রচনা সম্ভার ও বিষয়গত বৈচিত্র লক্ষণীয়। এদের মধ্যে কোন একটি বিশেষ গ্রন্থকে প্রিয় বলে চিহ্নিত করা সহজসাধ্য নয়। ব্যক্তিগত ভালো লাগা না লাগার উপর নির্ভর করে প্রিয়-অপ্রিয়ের বিচার। কোন একটিকে প্রিয় বলার অর্থ এই নয় যে, অন্যগুলির গুণ বা আবেদন গত উৎকর্ষ কে খাটো করে দেখা। যাই হোক, আমার প্রিয় গ্রন্থ হল অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীকান্ত’ প্রথম পর্ব।

আমার প্রিয় গ্রন্থ (সংক্ষিপ্ত কাহিনী):

শ্রীকান্ত মূল চরিত্রে আত্মকথনে ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের কাহিনী প্রকাশিত আমার প্রিয় গ্রন্থ । ‘শ্রীকান্ত’ প্রথম পর্ব দ্বাদশ পরিচ্ছেদে সমাপ্ত। গ্রন্থখানির প্রায় অর্ধাংশ জুড়ে আছে দুই কিশোর বালক শ্রীকান্ত ও ইন্দ্রনাথের জীবনের বিচিত্র কাহিনী অভিজ্ঞতা। স্কুল-মাঠে বল খেলাকে ঘিরে যে মারামারি বাঁধে, সেই রণাঙ্গনে ইন্দ্রনাথের সঙ্গে শ্রীকান্তের প্রথম পরিচয় হয় আকস্মিকভাবে। ব্যাঘ্ররুপী শ্রীনাথ বহুরূপীর আকর্ষিক আবির্ভাবে বাড়িসুদ্ধ সকলে যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তখন ইন্দ্রনাথই রক্ষা করে ওই সংকটাপন্ন অবস্থা থেকে। ওই রাত্রিতে দুই কিশোর অভিযাত্রী বেরোয় গঙ্গাবক্ষে নৌ অভিযানে। মাছ চুরি, সাপ ধরার মন্ত্র শেখার চেষ্টা– বহু ঘটনার নায়ক ইন্দ্রনাথের সহযাত্রী হয় শ্রীকান্ত। এভাবে উভয়ের পরিচয় যখন গভীরতর হচ্ছিল, সে সময় ইন্দ্রনাথের আকর্ষিক প্রস্থান ঘটল সপ্তম পরিচ্ছেদে। গ্রন্থের অবশিষ্ট পাঁচটি পরিচ্ছেদে আছে, শ্রীকান্ত- রাজলক্ষ্মীর প্রণয় জীবনের ইতিবৃত্ত।

চরিত্র:

‘শ্রীকান্ত’ প্রথম পর্বের প্রধান চরিত্র তিনটি – শ্রীকান্ত, ইন্দ্রনাথ ও রাজলক্ষী।পার্শ্ব বা অপ্রধান চরিত্র হলো অন্নদাদি, শাহজি, মেজদা, পিসেমশাই, পিসিমা, নতুন দা, নিরুদি, কুমার সাহেব, রতন প্রভৃতি। লেখকের অসামান্য, বর্ণনা গুণে, দরদী হৃদয়ের গভীর সহানুভূতি ও মমত্বে সব কটি চরিত্রই জীবন্ত। ইন্দ্রনাথ ডানপিটে, দুর্জয় সাহসী, অসাধারণ বাহুবলের অধিকারী, আবার তার ছোট বুকটি অপরিসীম স্নেহ ও মমতায় ভরা। রাজলক্ষ্মী অদৃষ্টচক্রে -বাইজি হলেও তার বাল্য প্রনয়ের মধুর স্মৃতি তারমধ্যে জীবনের প্রণয় পিপাসাকে উদীপ্ত করেছে, কিন্তু কঠোর সংযম, একনিষ্ঠ সেবাব্রত ও শুদ্ধাচারে তা পবিত্র ও ধন্য। নায়ক শ্রীকান্ত ভবঘুরে। সে চলমান জীবন পথের বর্ণনা দাতা। শ্রীকান্ত কেবল স্রষ্টাই নয়, তার কোমল হৃদয়ের উপলব্ধিতে, তার মমত্বের স্পর্শে তার বর্ণিত চরিত্রগুলি হীরক খণ্ডের মতো দীপ‍্যমান ও প্রানবন্ত। পার্শ্বচরিত্রগুলি নিতান্ত স্বল্পায়ত হলেও মুক্তো করার মতো উজ্জ্বল, পাঠকের হৃদয় মন এক নিমিষে কেড়ে নেয়।

অন্যান্য গুণাবলি:

‘শ্রীকান্ত’ আত্মজীবনীমূলক রচনা হতে পারে, তাতে থাকতে পারে ভ্রমণ- সাহিত্যের বৈশিষ্ট্যাদি, তবু ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাস। উপন্যাসের কাহিনী হয় আঁটোসাঁটো, পরিপূর্ণ নিটোল। কাহিনী মন্থর গতিতে এগোতে এগোতে জীবনের দৃঢ় সত্যকে উদ্ভাসিত করে – পূর্ণতার মহিমায় করে সার্থক। ‘শ্রীকান্ত’ প্রথম পর্বে অবশ্য আঁটোসাঁটো কাহিনী নেই, ঘটনাগুলি অধ্যায়ে অধ্যায়ে অনেকাংশে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়ানো-ছিটানো, তাহলেও ভ্রাম্যমান শ্রীকান্ত জীবনের সুতোয় তারা মালার মতো গাঁথা। আঙ্গিক ও রচনাশৈলীর দিক থেকে ‘শ্রীকান্ত’ বাংলা সাহিত্যের একটি সার্থক সংযোজন।

উপসংহার:

ভালোলাগা-মন্দলাগা বা প্রিয়-অপ্রিয় চিরন্তন নয়। বয়সের পরিবর্তনে অভিরুচির পরিবর্তন স্বাভাবিক। কিন্তু কালজয়ী সৃষ্টির অমরত্ব তো যাওয়ার নয়। ইন্দ্রনাথ, অন্নদাদি, নীরুদিরা, ক্ষণজন্মা – সংসারে কোটিতেও দু’চারটি মেলেনা। ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে তারা রেখা ও লেখার বাঁধনে চির আয়ুষ্মান ও আয়ুষ্মতী হয়েছে, আমার হৃদয়ে ও তাদের অক্ষয় অমর আসন বিছানো।


Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts
Scroll to Top