ভূমিকা
শৈশব এবং কৈশোর মানুষের জীবনের স্বপ্ন- রচনা কাল। এই সময়ে নানা রঙিন স্বপ্ন তার মনের মনিকোঠায় এঁকে দেয় তার অনাগত জীবনের কত-না বর্ণবহুল মানচিত্র। সেই স্বপ্নের সফলতাই তার জীবনের লক্ষ্য। মহাসমুদ্রে নাবিক যেমন ধ্রুব- নক্ষত্র লক্ষ্য স্থির রেখে বিশাল বারিধি- বক্ষে দিক্- নির্ণয় করতে পারে, তেমনি শৈশবেই মানুষ লক্ষ্য স্থির রেখে সেই লক্ষ্যকে জীবনের ধ্রুব-তারা করে জীবন মহা সমুদ্রে পাড়ি দিলে দিগভ্রষ্ট হয়ে বিপথগামী হবার কোনো আশঙ্কা থাকে না।
জীবনের লক্ষ্য স্থির করার প্রয়োজন কী?
সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে অভাবে কত মানুষ এই সীমাহীন পৃথিবীতে দিশেহারা হয়ে কান্ডারীবিহীন তরণীর মত ঘুরে বেড়ায় নিঃসীম বেদনায়। জীবনে সাফল্য লাভের জন্য চাই সুদূর সংকল্প। সেই সংকল্পই হবে তার জীবনী সাদা জাগ্রত কান্ডারী, জীবন- পথের ক্লান্তিহীন অভিভাবক ।
আসলে, আমাদের এই মানব- জমিন সোনা ফেলতে হবে। জীবনের জমিনে সোনার ধান ফলাতে হলে যথা সময়ে বীজ বপন এবং আনুষঙ্গিক পরিশ্রম ও এক নিষ্ঠুর সাধনার দরকার । তেমনি জীবনের স্বপ্নকে সার্থক করে তুলতে হলে প্রয়োজন একাগ্র সাধনা, প্রয়োজন অগ্রসরণের সুনির্দিষ্ট এবং সুপরিকল্পিত পথ-রেখা । সে পথ-রেখাই মানুষকে উপনীত করে দেবে তার জীবনের সফলতার স্বর্ণ -তরণী।
আমার লক্ষ্য কী?
আমি আধুনিক ভারতবর্ষের একজন সুদক্ষ কৃষক হতে চাই। দেশের কৃষির উন্নয়নে এই হল আমার জীবনে স্থীর লক্ষ্য।
আমার লক্ষ্যকে অনেকের সামান্য এবং দীন মনে করতে পারে । ‘কৃষক’ বলতে সবাই গতানুগতিক ধারার মান্ধাতার আমলের কৃষকদের কথা ভেবে থাকে। রানা রে আমাদের দেশের কৃষক সমাজের শিক্ষা নেই, স্বাস্থ্য নেই দুবেলা-দুমুঠো পেট ভরে খেতেও পায় না তারা। তাদের দারিদ্র্য চিরন্তন। তাদের বীজধান নেই ,হালবদল নেই, নেই আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রথম চাষবাস করবার ধ্যান- ধারণা। আমি সেরূপ পরিবর্তন-পরাঙ্মুখ, রক্ষণশীল কৃষক হতে চাই না। আমি আধুনিক যুগের শিক্ষিত ,সুদক্ষ, বিজ্ঞান- শিক্ষিত প্রগতিশীল কৃষক হতে চাই।
এরূপ লক্ষ্য স্থির করার কারণ
আমার বন্ধুদের কেউ হতে চায় ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার ,কেউ ম্যাজিস্ট্রেট ,কেউ-বা মুন্সেফ। চাকরিকেই সবাই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য স্থির করেছে।
কিন্তু স্বাধীন কৃষক-বৃত্তি কেউ জীবনের লক্ষ্য রূপে গ্রহণ করতে রাজি নয়। অথচ প্রাচীন ভারতে কৃষিই ছিল সমগ্রদেশের ধন সম্পদের উৎস। যে কৃষি কৃষি-মাতৃক ভারতবর্ষের অর্থনীতির মূল সূত্র এবং দেশের লোক সংখ্যার অধিকাংশের জীবিকার সংস্থান করে দেয়, তার পরিচালন- দায়িত্ব অবহেলিত ,নিরক্ষর,রুগ্ন পরিবর্তন- বিমুখ, দরিদ্র কৃষকদের হাতে তুলে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছি । আমাদের কৃষি ক্ষেত্র আজ নতুন এর আবির্ভাব- প্রত্যাশায় পথ চেয়ে বসে আছে। দেশের শিক্ষিত যুব -সমাজের কেউ কি অভাগিনী মাটির ডাকে সাড়া দেবে না? বস্তুত, আমার এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পশ্চাতে আছে কবিগুরুর একটি গানের সুমহান প্রেরণা: ‘ফিরে চল মাটির টানে।’ আমি সেই অভাগিনী মাটির টানে মান্না মাটির কাছে ফিরে যেতে চাই।
দেশের অবস্থার সঙ্গে আমার লক্ষ্যের যোগ
স্বাধীনতা লাভের পর দীর্ঘ 72 বছর অতিবাহিত হল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, ভারতের কৃষি অবস্থা আজও ‘যথা পূর্বম্। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে কৃষির উন্নতি ভিন্ন শিল্পের উন্নতি নেই। কৃষিক্ষেত্রে আজও ভারতে সেই চির -পরিচিত হাসিম শেখ ও রামা কর্তব্যের দল তাদের চিরাচরিত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে চলেছে। ভোঁতা লাঙল ,রুগ্ন হালবলদ ,নিকৃষ্ট বীজ নিয়ে তারা সারাহীন জমিতে যথাসম্ভব স্বল্প -পরিমাণ ফসল ফলায়। তাতে তাদের পেট ভরে না, দারিদ্র্য ও ঘোচে না। চোখের জলে আর ঘামে মাটি ভিজে ওঠে। তবু চাষের জল তারা পায় না। আমি আবার বুক বেঁধে মাথা উঁচু করে আমাদের সেই দরিদ্র, হতাশাক্লিষ্ট ,ভাগ্যহত কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে চাই।
সংকল্পের সাধনা
আমার লক্ষ্য-পূরণের জন্য বিশুদ্ধ বিজ্ঞান নয়, কৃষি বিজ্ঞানই হবে আমার পাঠ্য। কৃষি বিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আমি আমাদের কৃষিক্ষেত্রে নেমে পড়বো। আমাদের যেটুকু জমি বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে, সন্নিহিত জমির মালিকদের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে বিনিময়ের সাহায্যে তাদের একজোট করবার চেষ্টা করব। আমার সে চেষ্টা সফল হলে চারদিকে উঁচু বাঁধ দিয়ে মধ্যবিত্ত সব আলবাঁধ অপসারিত করব।
তারপর আমাদের সামান্য যে পুঁজি আছে, তা দিয়ে একটা ট্রাক্টর কেনবার ব্যবস্থা করব। তারপর একটা গভীর নলকূপ বসাবো ব্যবস্থা করতে হবে এবং সেই সঙ্গে একটি উঁচু করে একটি মাত্র নির্মাণ করে নিতে হবে। নলকূপ থেকে উত্তোলিত তাদের সঞ্চিত থাকবে এবং প্রয়োজনমতো তা ব্যয় করা হবে।
উৎকৃষ্ট বীজ ও সার ক্রয় করে ফসলের রকমফেরের ব্যবস্থাও করব ।আমার কৃষি- উৎপাদন- পদ্ধতির প্রতি সকলের দৃষ্টি ও মনোযোগ আকৃষ্ট হলে আমি তাদের সম্মুখে রাখবো সমবায় কৃষি- খামারের প্রস্তাব তাতে তাদের কল্যাণ হবে দেশের কল্যাণ হবে।
উপসংহার:
জানি জীবন- লক্ষ্য উপনীত হবার পথে আসে নানা বাধা ,নানা প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু আমি যদি আমার লক্ষ্য- সিদ্ধির পথ থেকে বিচ্যুত না হই, কোন বাধা আমাকে টলাতে পারবে না। আমার বিশ্বাস আমার একাগ্রতায় আমাকে সাফল্যের সিংহদ্বারে দেবে পৌঁছিয়ে, আমার প্রাণে যোগাবে নতুন উদ্যম ও নতুন প্রেরণা আমার জীবনের শপথ হবে-
‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন।’
তোমার জীবনের লক্ষ্য (The Goal of Your Life) ( ডাক্তার )