ভূমিকা
বদ্ধ জল যেমন পঙ্কিল হয়ে ওঠে, চেতনা প্রসার হীন মনুষ্যসমাজও তেমনি আবিল। শিক্ষা বিস্তারের অন্তরে আলোকপ্রাপ্ত হলে তবে মানুষ মুক্তমনা হয়। অন্যথায় কুসংস্কারের অন্ধকূপে কুপ মন্ডুক হয়ে বসবাস ছাড়া তার গতি নেই। স্রোতই জীবনের গতি। সেই স্রোতের জন্য, আবিলতা কাটিয়ে নির্মল হওয়ার জন্য প্রয়োজন শিক্ষার। অশিক্ষা, অজ্ঞতা মানুষকে এবং সমাজকে পদে পদে লোকাচারের শৃংখলে বেঁধে মনুষ্যত্ব বিবর্জিত প্রাণী রূপে প্রতিভাত করায়। দেশের সমাজের এবং জাতির উন্নতির জন্য সর্বাগ্রে দরকার সুশিক্ষার -বিজ্ঞান চেতনার।
জনসমাজে বিজ্ঞানচেতনা প্রসারের প্রয়োজনীয়তা
বিজ্ঞান অর্থে বিশেষ জ্ঞান। বিজ্ঞানের দুটি রূপ। একটি হলো অপরিবর্তনশীল সত্য, অপরটি পরীক্ষিত সত্য। দুটি সত্যে উপনীত হতে হলে চাই শিক্ষা, চাই জ্ঞান। বিশেষভাবে জানার সেই জ্ঞানই হলো বিজ্ঞান। বিজ্ঞানমনস্কতা মানুষের মনের সংস্কারের জগদ্দল পাষাণ কে দূরে ফেলে প্রকৃত সত্যের সন্ধান দেয়। বিজ্ঞানমনস্কতা সুস্থ, সৎ, স্বাভাবিক সমাজ তৈরি করে। বিজ্ঞানমনস্ক তাই এনে দেয় মুক্তমনের দখিনা হাওয়া। লোকাচার আর কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ সমাজের জীবেরা। পদে পদে বিধিনিষেধের গণ্ডি উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টি করার ফলে জীর্ণ আবর্তে পাক খেয়ে চলেছে তারা। একদিকে ব্রত উপবাস পালা পার্বণের নামে যেমন না খেয়ে শুকিয়ে মরছে, অলীক উদ্দেশ্যে হাত পেতে আশার ছলনায় দিনযাপন করছে, অন্যদিকে তেমনি উপযুক্ত পুষ্টি, চিকিৎসার অভাবে পরমায়ু কে নিজের অজান্তে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর করে তুলছে। প্রকৃত জ্ঞান ও শিক্ষার অভাবেই বিশেষ কোনো রোগ কে কোন দেবীর রোষ মনে করে ফুল, বেলপাতা, কি মন্ত্রপূত জল দিয়ে দেবীর সন্তোষ প্রার্থনা করছে। কিছুদিন আগেও আরাধ্যা চাঁদের মাটিতে পা দেবার জন্য আমেরিকার উপর নিতান্ত রুষ্ট ছিল বেশ কিছু মানুষ। মানুষের মনের থেকে এই সংস্কার দূর করতে হলে জনসমাজে বিজ্ঞানচেতনা বাড়ানোর প্রয়োজন। প্রতিটি লোকাচার, প্রতিটি সংস্কারের ব্যাখ্যা মুক্ত মনে করে, তার সারবত্তা এবং অসারতার কথা জানাতে হবে জনসমাজকে। জনসমাজ বিজ্ঞানচেতনা পুষ্ট হলে দেশের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে।
ছাত্র সমাজের কর্তব্য
সমাজের প্রতিটি স্তরে বিজ্ঞান চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার অন্যতম দায়িত্ব ছাত্রসমাজের। দেশের শক্তি, বল, ভরসাস্থল তারাই। তারাই এগিয়ে চলে যুগোপযোগী গতিতে। বুকে তাদের অদম্য সাহস, মনে তাদের নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন। তাদের আশা উন্নত সমাজ, মুক্তমন ও শিক্ষার আলোতে ভরিয়ে তুলবে ভুবন। এই ব্রত সংকল্প করেই তারা সভ্যতার অভ্যুত্থানে নির্ভরযোগ্য ভূমিকা পালন করে। নতুন শিক্ষার আলোকে আলোকিত হয়ে তারা বিশ্বের উন্নত দেশগুলি কে দেখে, বিশ্লেষণ করে জ্ঞাত হয় যে, উন্নত দেশগুলির উন্নতি ঘটিয়েছে সে দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার বিজ্ঞান চেতনা। কি শিক্ষায়, কি কৃষিকার্যে, কি প্রাকৃতিক সম্পদ উদ্ধারে, কি কাজে কর্মে মানসিকতায় আবেগ বিবর্জিত হয়ে তারা সাধনা করেছে বিজ্ঞানের। পালন করেছে বৈজ্ঞানিক প্রনথার। শুধুমাত্র নির্মাণ কিংবা আবিষ্কারের ক্ষেত্রেই নয়, তাদের প্রতিটি কাজে মানব সমাজের উন্নতি কল্পে যুক্তিগ্রাহ্য পদক্ষেপ নিয়েছে তারা। এই যুক্তিগ্রাহ্য পদক্ষেপই বিজ্ঞান। ল্যাবরেটরীতে নানা উপাদানের মিশ্রণ যেমন বিজ্ঞান, যুক্তি নির্ভরতা ও তেমনি বিজ্ঞান। এদেশের জনসমাজে এ কথা বোঝাতে হবে যে, অলীক অবাস্তব কল্পনার বশে কিংবা আশায় সম্ভাবনাকে জলাঞ্জলি না দিয়ে যুক্তির দুয়ারে এসো। ছাত্র সমাজ ছাড়া এ কথা প্রচার এর ভার আর কে নেবে? একবিংশ শতাব্দীতে ‘ডট কম’ এর যুগের দাঁড়িয়েও আজ আমাদের শুনতে হচ্ছে, ডাইনি সন্দেহে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে,’ ভুতে ধরেছে’ বলে কোন স্নায়বিক রোগীকে শারীরিক নির্যাতন করা হচ্ছে, কোনো সংক্রামক ব্যাধির বিনাশে ‘চরণামৃত’ পান করানো হচ্ছে রোগীকে। বস্তুত আজও অশিক্ষায় পূর্ণ হয়ে আছে মনুষ্যসমাজ। সেই সঙ্গে ভারতবর্ষের আর্থিক অপুষ্ট তার কারণে বিজ্ঞানের সঙ্গে পূর্ণ পরিচয় বা সম্পূর্ণ বিজ্ঞান নির্ভর হতে পারছি না আমরা। দেশে এখনও বৈজ্ঞানিক উপাদান প্রাচুর্যের অভাব আছে। যার ফলে আধা জানা আধা না জানা অবস্থায়, অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী দশা প্রাপ্ত হয়ে আরো বিশৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞানচেতনা প্রসারে। ছাত্রসমাজ এই অবস্থায় তাদের পঠন-পাঠন সূত্রে জ্ঞাত তথ্য ছড়িয়ে দিতে পারে সমাজে। নতুন কোনো তথ্যের সন্ধান ইন্টারনেট মাধ্যমে করে, তার পূর্ণ পরিচয় বিকশিত করতে পারে জনসমক্ষে ও সমাজে।
উপসংহার
বিশ্বের উন্নত দেশগুলি আজ বিজ্ঞাননির্ভর হওয়ার ফলে তাদের ক্রমোন্নতি দিনকে দিন বেড়ে চলেছে। কিন্তু আমাদের দেশের আশি শতাংশ মানুষ গ্রামবাসী, নিরক্ষর, কৃষক, শ্রমিক, শোষিত, নিরন্ন। এদেশের সর্বসাধারণ স্তরে বিজ্ঞানচেতনা প্রসার করতে হলে সর্বপ্রথম তাদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে। তারপরে কাজ হচ্ছে তাদের মন কুসংস্কার মুক্ত করা। গ্রামের প্রতিটি ছাত্র তাদের এবং তাদের পাশের বাড়ির সদস্যদের মধ্যে বিশ্বের বিজ্ঞান সাধনা সংবাদ পৌঁছে দেবে, ছোটখাটো কুসংস্কারও কুপ্রথার বিরুদ্ধে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ দাখিল করে সামাজিক দের উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় বিজ্ঞানের জগতের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করানোর চেষ্টা করবে। উদ্ধতভাবে বা জোর করে নয় – তাদের মত করে, তাদের অবস্থানে অবস্থিত হয়ে তাদের বৈজ্ঞানিক চেতনায় আগ্রহী করে তুলতে হবে। অজানাকে জানার সনন্দ কৌতুহল জাগিয়ে তুলেই জনসমাজে বিজ্ঞান চেতনার প্রসার ঘটাবে ছাত্রসমাজ।