” সৈন্যদল দ্বারা যুদ্ধ সম্ভব, কেবলমাত্র জনতার দ্বারা নহে। জনতা নিজেকেই নিজে খন্ডিত প্রতিহত করিয়া থাকে। তাহাকে চালনা করাই কঠিন।”
–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভূমিকা:-
সৈন্যদল ও জনতার মধ্যে পার্থক্য শৃঙ্খলা মাত্রায়। শৃঙ্খলা জীবনে শ্রী সম্পদ এনে জীবনকে করে তোলে সুন্দর। শৃংখলাবদ্ধ সাধারণ মানুষ হয় অসাধারণ লৌহ দৃঢ় ক্ষমতার অধিকারী। এই নিয়ম শৃঙ্খলার সূতিকাগৃহ হল ছাত্র জীবন। ইংরাজিতে একটি প্রবাদ বাক্য রয়েছে—-“The Battle of Waterloo was won at the playground of Eton and Harrow”. অর্থাৎ ইটনেট খেলার মাঠে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা ও সুশৃঙ্গলতা পালন করেছিলেন বলেই উত্তর জীবনে ডিউক অফ ওয়েলিংটন দুর্ধর্ষ বীর নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে জয়ী হতে পেরেছিলেন।
বিশ্বপ্রকৃতির শৃঙ্খলার রাজ্য :-
মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে প্রকৃতির কোলে কিন্তু কোন এক অদৃশ্য কোন এক অদৃশ্য ব্যক্তি অযাচিতভাবে মানুষকে ঠেলে দিয়েছে অনুশাসন ও শৃঙ্খলা বোধের নিয়মে। সাতরঙা রামধনু গোলাপ কিংবা পদ্মের সুসজ্জিত পাপড়িগুলি দেখতে দেখতে কার মন না উদাস হয়? এই অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যের আধার হলো সুশৃঙ্খলা। তাই এরা আমাদের এত প্রিয়। শৃঙ্খলাই সৌন্দর্য আর যাবতীয় সৌন্দর্যের মুলে এই শৃঙ্খলা। বিশ্বব্যাপী এই শৃঙ্খলার অবিচ্ছেদ্য বন্ধন রোজই সূর্যোদয় সূর্যাস্ত হচ্ছে জোয়ার ভাটা হচ্ছে চন্দ্রের কলার হ্রাসবৃদ্ধি ঘটছে । পূর্ণিমায় পূর্ণত্ব পাচ্ছে ছটি ঋতু নির্দিষ্ট সময় মত ফুল ফুটিয়ে মানুষের প্রাণ জাগিয়ে আবার চলে যাচ্ছে। এই নিয়ম শৃঙ্খলার অনু মাত্র অপরূপ ঘটলে উদ্ভিয়া উঠিবে বিশ্ব পঞ্জ পঞ্জ বস্তুর পর্বতে।
জীবনের সর্বত্র শৃঙ্খলার রাজত্ব:-
প্রতিটি কর্মের আছে একটি সুশৃঙ্খলা ধারাক্রম যার নাম ছন্দ। সেই ছন্দই শৃঙ্খলা প্রতিটি সাফল্যের চাবিকাঠি। জীবনের সকল ক্ষেত্রে সৌন্দর্য। সৌষ্ঠব ওসৌকর্ষ নির্ভর করে যথাবিধি নিয়ম শৃঙ্খলার ওপরে। শৃঙ্খলার সাথে নিয়মানুবর্তিতা অর্থাৎ প্রতিটি কর্তব্য যথা সময়ে সঠিক ভাবে পালন করা অবশ্য উচিত। কিন্তু প্রতিটি সমাজবদ্ধ জীব যদি খেয়ালখুশিমতো যথেচ্ছাচার শুরু করে তবে সমস্ত সমাজ জুড়ে এক উচ্ছৃঙ্খলতা রাজত্ব চলবে। নিয়মের সামান্যতম ব্যতিক্রমে সমস্ত সমাজ জীবন ঘটিয়ে আসতে পারে এক ঘর তর বিশৃঙ্খলাতা এই অভ্যাস বা শৃঙ্খলার রাজত্বে পড়ুয়া ছাত্র পড়ার সময় পড়তে বসে। স্নানের সময় স্নান করে খাওয়ার সময় খায়। এতে তার মধ্যে সংযম ও শিষ্টাচার বিকশিত হয়। কখনো সে স্নানাগার ছেড়ে ঝড়ো কাকের মত কাজে মাতে না। তাই সময় ও নিয়মানুবর্তিতা মানব জীবনের a’great virtue’.
ইতিহাসের গতি:-
ইতিহাসের পাতায় পাতায় আজও আমরা দেখি শৃঙ্খলার গুরুত্ব। প্রাচীন গ্রীস ও রোম এই সুশৃঙ্খলা তার সাহায্যে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ করেছিল কিন্তু এর অন্যথা ঘটায় পরবর্তীকালে তার ধ্বংস হয়। স্পার্টার অধিবাসীরা চরম অনুশাসন ও কঠোর শৃঙ্খলার মাধ্যমে ছিল দুর্ধর্ষ। ভারতে ও মৌর্য বা গুপ্ত যুগ চরম নিয়মানুবর্তিতায় একে স্বর্ণযুগে রূপান্তরিত করেছিল। কিন্তু শৃঙ্খলাবোধের চরম অবনতিই বর্তমান ভারতের সংহতির বিপন্ন করেছে। আধুনিক জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত হলেও ও আশ্চর্য অনুশাসন ও দেশবাসীর একাগ্র নিষ্ঠা ও নিয়মানুবর্তিতার বলে বলিয়ান জাপান বিশ্ব অর্থনীতিতে তৃতীয় স্থানের অধিকারী। ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে আমাদের এসব শেখা উচিত।
ছাত্রজীবনই নিয়মানুবর্তিতার শ্রেষ্ঠ সময় :-
ছাত্র জীবনই শৃঙ্খলা বোধ ও সামাজিক দায়িত্ব অনুশীলনের উপযুক্ত সময়। এই সময় সজীব কোমল মানব ভূমিতে দায়িত্ববোধের অভিষেক হলে নিয়মানুবর্তিতার প্রভাবে উত্তরকালে সোনার ফসল ফলে।
প্রাচীন শিক্ষয় শৃঙ্খলার স্থান:-
শৃঙ্খলাবদ্ধ সুসংহত সৈন্যবাহিনীরা যুদ্ধ করতে পারে।তাই প্রাচীন ভারতে সৈন্য শিক্ষায় শৃঙ্খলাবধোর জাগরণ ঘটানো হত।’ছাত্রনামাঃঅধ্যায়নং তপঃ’কথাটি সত্য।কিন্তু অধ্যয়ন বলতে শুধু পুঁথিগত মুখস্থ বিদ্যাকে বোঝায় না।সেই সঙ্গে নিয়মানুবর্তিতার পাঠ ও দেওয়া হত, তাই প্রাচীন ভারতের নালন্দা কিংবা তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বে প্রথম স্থান অধিকার করতে পেরেছিল। তখন ব্রহ্মচর্য ছিল জ্ঞানের আকর পরম শ্রদ্ধার আকর্ষণ।
শৃঙ্খলা শৃঙ্খল নয়:-
শৃঙ্খলা বোধের মানসিক দিকটিকে কেউ যদি শৃঙ্খলের ন্যায় পদে যুগলে গ্রন্থিত করে তবে সেটা তারই অদূরদর্শিতার পরিণাম। তাতে সমাজ প্রাণহীন নিরস হয়ে পড়ে। সামাজিক চরিত্র যথাযথ বিকাশ লাভ করে। জীবন কূপমন্ডুক সম হয়ে ওঠে। তাই যুগে যুগে দেখা গেছে অর্থহীন যুক্তিহীন বাধা নিয়মের কোপে পড়ে বহু সমাজ ও জাতির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে।
সুশৃঙ্খল ও ছকে বাঁধা জীবনের মূল্য:-
শৈশবে মনোবৃত্তি কোমল প্রলাপ থাকে। তাই সুকোমল শিশুমনের বিকাশে শৃঙ্খল আলোক আনা চাই। বাড়িতে গৃহশিক্ষক স্কুলের সহ শিক্ষক দাদা দিদি ভাই বোন সর্বোপরি বাবা-মার অপরিমেয় স্নেহ সিঞ্চিত আদর্শ তাকে পালন করতেই হবে। তাই বড় হয়ে তাকে দীপ্ত ও সুকুমার করে তুলবে। রেলওয়েল টিকিট কাউন্টারের বিশাল লাইন দেখে সে বিনা টিকিটে রেলে চরবে না বা গুঁতোগুঁতি করে শারীরিক বল প্রকাশ করবে না— লাইনে অপেক্ষা করে নিজ ধৈর্য প্রমাণ করবে। বড়দের কোন অসংযত কাজের ত্রুটি তারা শুধরে দেবে সংযত ও শ্রদ্ধা বিনয়ের সাথে। এভাবে তার ব্যবহার তার পরিচয় হয়ে উঠবে। চরিত্রের সুষম বিকাশই হল নিয়মানুবর্তিতার মূল্য।
ছাত্র সমাজে উচ্ছৃংখলতার কারণ:-
শৃঙ্খলা নিয়মানুবর্তিতা ও শোভনার শিক্ষা যারা শৈশবে গ্রহণ করে না তারাই উচ্ছৃংখল আচরণে নিজেদের ও সংশ্লিষ্ট সকলের জীবনকে কণ্টকিত করে তোলে। শিক্ষাগত ডিগ্রী লাভ করলেও এদের মনের আদিম পশুটা বেঁচে থাকে চিরকাল। আর তাই একই পরীক্ষা হলে অসদুপায় অবলম্বন করা ধরা পড়লে মারমুখো হয়ে ওঠা পরীক্ষা ভন্ডুল করে শান্তিপ্রিয় পরীক্ষার্থীদের জীবনে বিরম্বনা ডেকে আনা ট্রামে, বাসে অকারনে বিরক্ত জাহির করা। উপযাজক হয়ে উপকারের নামে অপকার করা, হাসপাতলে রোগী দেখতে গিয়ে উচ্চনাদে গল্প-গুজবে মত হওয়া অথর্ব পিতাকে স্বনির্মিত বাসগৃহ থেকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে বিদায় করা প্রভৃতি নানা অশালীনতা ও প্রবীণ সমাজের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা বোধ সু সমাজকে করে তোলে এক অসামাজিক কার্যকলাপের আবাসভূমি রূপে।
উপসংহার:-
কৈশোরের সোনালী স্বপ্ন সার্থক করতে হলে চাই শৃঙ্খলাবোধের শিক্ষা। নিয়মে রাজ্যে যে অনিয়ম ও উচ্ছৃংখলতা রাজত্ব চলতে পারে না তা বোঝবার জন্যই কবিগুরু বলেছেন—–
” মুক্তি? ওরে মুক্তি কোথায় পাবি ,মুক্তি কোথায় আছে! আপনি প্রভু সৃষ্টি বাঁধন পরে বাঁধা সবার কাছে। ”
ছাত্র সমাজকে এখন মনে রাখতে হবে যে ছাত্র জীবনই হল দায়িত্ববোধের বিকাশের কাল। সামাজিক কর্তব্যবোধে দীক্ষিত হবার সময় বর্তমানে নৈরাশ্যের অন্ধকার কিংবা রুচি বিকৃতির কুয়াশা অপসারিত হয়ে শীঘ্রই নতুন আশা ও আদর্শের সূর্যোদয় ঘটবে। এরপর আসবে নতুন দিন নতুন জীবন। আমাদের ছাত্রসমাজ যেন তাকে বরণ করার জন্য থাকে চির প্রতীক্ষামান।
সমাপ্ত