ভূমিকা
মানব জীবনের শৃঙ্খলা বোধ সম্পর্কে আলোচনা করার আগে দেখা প্রয়োজন, শৃঙ্খলা বলতে কী বোঝায়? শৃংখলার যথার্থ স্বরূপটি মানুষের কার্য ও আচরণের মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হয়। নিয়মানুবর্তিতা আনুগত্য যথোচিত আচরণ প্রভৃতি গুণের সমন্বয় হচ্ছে শৃঙ্খলা।
মানব জীবনের শৃঙ্খলা প্রয়োজনীয়তা
জীবনের সর্বস্তরে ও সর্বক্ষেত্রে শৃংখলার প্রয়োজন সর্বাধিক। এর প্রধান শৃঙ্খলা ব্যতিরেকে মানব জীবনে সাফল্য লাভ করা যায় না। শৃঙ্খলাই মানব জীবনের চলার পথকে সুগম করে দেয়। তবে কঠোর বিধিনিষেধের মধ্য থেকে ছাত্র জীবনে শৃঙ্খলা আয়ত্ত করার উপযুক্ত সময়। অন্যদিকে, মানব জীবনে শিক্ষার প্রারম্ভিক পর্যায় অর্থাৎ ছাত্র জীবনে শৃঙ্খলা আয়ত্ত হলে এবং শৃঙ্খলা বোধের অভ্যস্ত হলে সারা জীবন এর সুফল ভোগ করা যায়। ছাত্রজীবনে অর্জিত শৃঙ্খলা যে মানব জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে কতখানি কার্যকর এবং সুফল হতে পারে তা ইংরেজ সেনাপতি ডিউক অব ওয়েলিংটন এর উক্তি স্মরণীয় হয়ে আছে। ওয়াটার লুর যুদ্ধে সম্রাট নেপোলিয়নের বাহিনীকে পরাজিত করে তিনি যে গৌরব অর্জন করেছিলেন, সেই প্রসঙ্গে ডিউক অব ওয়েলিংটন বলেন –‘The Battle of Waterloo was won in the play field of Eton.’ অর্থাৎ ঈটন বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে তিনি যে শৃঙ্খলা আয়ত্ত করেছিলেন তাই তাকে জয়লাভ সক্ষম করেছে।
শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা সময়ানুবর্তিতা
শৃঙ্খলার সঙ্গে নিয়মানুবর্তিতাও সময়ানুবর্তিতার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। যে ব্যক্তি অনিয়মিতভাবে ও অসময়ের কাজ করে তার জীবন প্রায় ই ব্যর্থ হয়। শৃঙ্খলার অভাবেই মেধা ও বুদ্ধি থাকা সত্বেও বহু ব্যক্তি জীবনে আকাঙ্ক্ষিত কৃতিত্বে উজ্জ্বল হতে পারেনি। যে ছাত্র দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে, বইপত্র বিশৃংখল ভাবে ছড়িয়ে রাখে, নিজের জামা জুতো যথাস্থানে রাখে না, তাকে প্রতি পদে নানা অসুবিধায় পড়তে হয়। পড়ার সময় বইপত্র খুঁজতে, স্কুলে যাওয়ার সময় জামা জুতো খুঁজতে তার সময় চলে যায়। ফলে তার স্কুলে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যায়। মানব জীবনের অন্যান্য পর্যায়েও সময়ের কাজ সময়ে না করলে বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। সময়াভাবে বিশৃঙ্খল মানুষকে তাড়াহুড়োর মধ্যে দিয়ে অগোছালোভাবে সারতে হয় বলে তার কোন কাজ-ই সম্পূর্ণরূপে সার্থক হয়ে ওঠে না। ফলে সেই কাজের যথার্থ ফল ও সে পায় না। শৃঙ্খলা হীনতা শুধু নিজেরই ক্ষতি করে না, অন্যের ও অনিষ্ট সাধন করে। যে ব্যক্তি দেরি করে কাজ করে, কাজের ফল লাভে যেমন সে নিজে বঞ্চিত হয়,যার জন্য কাজটি করা হল, সেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একজনের অমনোযোগী উচ্ছৃংখল আচরণ সমগ্র ব্যক্তি সাধারণের পক্ষে কলঙ্কময় মনে হতে পারে।
শৃংখলার অভ্যাস গৃহে
শিক্ষা অর্জনের মত শৃঙ্খলা অর্জন ও সহজ নয়। সযত্ন প্রয়াস নিয়মিত চর্চা ও অনুশীলনের দ্বারা শৃঙ্খলাকে আয়ত্ত করতে হয়। ছাত্র জীবন যেমন, শৃঙ্খলা অর্জনের উপযুক্ত সময়, গৃহ ও বিদ্যালয় তেমনি এর উপযুক্ত স্থান। বস্তুত গৃহেই শৃঙ্খলা শিক্ষার প্রথম পাঠ গ্রহণ করতে হয়। এখানেই শৃঙ্খলা বোধের উন্মেষ হয়। মানবজীবনে বাল্যকালে শৃঙ্খলার ক্ষেত্রটি অত্যন্ত ব্যাপক। জীবনের নানা দিকে তা প্রসারিত। কঠোর বিধি-নিষেধের মধ্যে দিয়ে প্রতিদিন নিদ্রাভঙ্গ হওয়া থেকে শয্যা গ্রহণ পর্যন্ত সকল কাজ নিয়মিত এবং যথাযথ ভাবে সম্পন্ন করতে হবে। ঠিক সময়ে ঘুম থেকে ওঠা, প্রাত্যহিক কাজ যথাবিধি করা থেকে শুরু করে নিত্যকার যাবতীয় কাজ সুশৃংখলভাবে করার অভ্যাস এর মধ্য দিয়েই শৃঙ্খলা বোধ ক্রমশ জাগ্রত হয়ে ওঠে। পিতামাতা এবং অন্যান্য গুরুজনদের কানু ভর্তি হওয়া এবং পারিবারিক রীতিনীতি যথাযথভাবে পালন করাও শৃঙ্খলা অন্তর্ভুক্ত গৃহে পর বিদ্যালয় হচ্ছে মানুষের শৃঙ্খলা শিক্ষার স্থান বিদ্যালয় শিক্ষক মহাশয় এর অনুগত হয়ে যেমন তার সকল আদেশ পালন করতে হবে তেমনি বিদ্যালয়ের নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে তবেই সেবায় ছাত্র অভ্যস্ত হবে উশৃংখলতা আয়ত্ত হবে |
শৃংখলার অভ্যাস স্কুলে
ছাত্র জীবনে পাঠ্যবিষয়ের বহির্ভূত স্কাউটিং, এন.সি.সি প্রভৃতির মাধ্যমে শৃঙ্খলা শিক্ষা লাভ করা যায়। এছাড়া খেলার মাঠ ছাত্রদের শৃঙ্খলা আয়ত্ত করার আরো একটি প্রশস্ত ক্ষেত্র। ইংরেজিতে যাকে ‘Sportsman spirit’ বলা হয় তা খেলার মাঠে খেলোয়াড়দের সুশৃংখল আচরণে নামান্তর। তবে গৃহে,বিদ্যালয়ে, খেলার মাঠে সর্বত্রই ছেলে মেয়েদের সুশৃঙ্খল পথে চালিত করার জন্য গুরুজনদের, শিক্ষক মহাশয়ের সযত্ন নির্দেশ দিতে হবে এবং সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। শৃঙ্খলার অনুবর্তী হওয়ার জন্য যেমন তাদের উৎসাহিত করতে হবে, শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য তেমনি শাস্তি দান করতে হবে।
মানুষের সমাজ সম্পর্কে কৌতূহল ও চেতনার বিকাশ
যে সমাজ পরিবেশে মানুষ বাস করে তার সম্পর্কে উদাসীন থাকা অপরাধ।সমাজে সংঘটিত সকল ঘটনার গতি প্রকৃতি ও তার পরিণাম সম্পর্কে সজাগ থাকা প্রয়োজন। বাল্যা বস্থায় জীবনের পক্ষে প্রয়োজনীয় যাবতীয় শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। সংসারের মালিন্য মুক্ত কুসুম কোমল হৃদয় পটে জীবনের সকল শিক্ষণীয় বিষয় সহজে অঙ্কিত হতে পারে। বিদ্যার্জন কে প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে গ্রহণ করে ও সামাজিক মানুষ হিসেবে পরিবেশ সম্বন্ধে সচেতন থাকা উচিত। শিক্ষার বৃন্তেই জীবনের অন্যান্য জ্ঞাতব্য বিষয় পুষ্পিত হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, যখন দেখা যায় বিশ্ব সংসার সমাজ পরিবেশ এমনকি নিজের দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্য উপেক্ষা করে মানুষ শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে আছে। দেশের সামাজিক সমস্যা, অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি, রাজনীতি, খেলাধুলা, সাম্প্রতিক বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে তাদের জিজ্ঞাসা ও উৎসাহ জাগরুক করা সমাজ শ্রেণীভূক্ত অন্য সকল মানুষের কর্তব্য।
উপসংহার
শৃঙ্খলা সঙ্গে শ্রী ও সৌন্দর্যের সম্পর্কটি ঘনিষ্ঠ। যা সুশৃঙ্খল তাই সুন্দর। সে দিক দিয়েও মানবজীবনে শৃঙ্খলার অবদান কম নয়। প্রত্যেক মানুষেরই কর্তব্য নিজেকে সুন্দর করে গড়ে তোলা। এজন্য তাকে সুশৃঙ্খল হতে হবে। পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণে সুশৃঙ্খল মানবজীবন তাই শ্রী মন্ডিত হয়, সে স্বভাবতই সকলের প্রিয় হয়। অন্যদিকে অনেক আপাত সুন্দর মানুষকে তাদের অপরিচ্ছন্ন সাজসজ্জায় এবং বিশৃঙ্খল আচরণে কুশ্রী বলে মনে হয়।শৃঙ্খলা শিক্ষা করার সময় প্রথম প্রথম একে বড় কঠোর বলে মনে হতে পারে। শৃঙ্খলা যেন শৃঙ্খল হয়ে ওঠে। কিন্তু একবার শৃঙ্খলায় অভ্যস্ত হয়ে উঠলে তা জীবনের অঙ্গীভূত হয়ে যায়। তখন আদৌ একে আর শৃঙ্খল বলে মনে হয় না। জীবনের অঙ্গীভূত সমাজ ও স্বতঃস্ফূর্ত শৃঙ্খলাই যথার্থ শৃঙ্খলা, আরোপিত শৃঙ্খলা শৃঙ্খলা নয়- মানুষকে এই কথাটি স্মরণ রাখতে হবে।