ভূমিকা
পৃথিবীর প্রথম মানুষটি সবচেয়ে বিশুদ্ধ বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়েছিল। সবচেয়ে বিশুদ্ধ জল পান করেছিল। তারপর এই পৃথিবীতে এলো পরিবেশ দূষণ। যন্ত্রসভ্যতার দ্রুত উন্নতির ফলে মানব জাতির জৈবিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ আশাতিত রুপে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সঙ্গে যন্ত্র রাক্ষসীর বিষ নিঃশ্বাসে মানুষের জীবন সংকটপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নাগরিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার সমগ্র পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ও পরিবেশ দূষিত করে তুলেছে। তাই পরিবেশ দূষণ মানুষের সৃষ্ট একটি নতুন সমস্যা। একে কেন্দ্র করে পরিবেশ বিজ্ঞান নামে একটি নতুন বিজ্ঞানের সৃষ্টি হয়েছে। সমগ্র পৃথিবীর বিজ্ঞানী এই সমস্যার সমাধানে সচেষ্ট হয়ে উঠেছেন।
পরিবেশ দূষণের কারণ
পরিবেশ দূষণের মূল কারণ রয়েছে এর মধ্যে নিম্নোক্ত গুলি প্রধান শহরের রাস্তায় প্রতিনিয়ত যন্ত্র চালিত যানবাহন থেকে নিঃসৃত ধোঁয়া বায়ুমন্ডলকে দূষিত করছে। এছাড়া প্রায় সব ধরনের শিল্প কারখানা বায়ু দূষণের উপকরণ যোগান দিয়ে চলেছে। এদের মধ্যে থার্মাল পাওয়ার জেনারেশন, অয়েল রিফাইনারি, সিমেন্ট উৎপাদন ,এবং সার শিল্প, যাবতীয় ইস্পাত শিল্প, মেশিন সপ্ ইত্যাদি মারাত্মক বর্জ পদার্থের সাহায্যে বায়ুদূষণ হয়ে চলেছে। বায়ুদূষণ বস্তুর মধ্যে আছে মানবদেহের পক্ষে ক্ষতিকর বেঞ্জোপাইরিন, অক্সাইড অব নাইট্রোজেন ও সালফার, কার্বন মনো অক্সাইড, কার্বন-ডাই-অক্সাইড প্রভৃতি। এগুলো ছাড়াও রয়েছে শব্দ ও পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তা জনিত দূষণ, কল কারখানার পরিতক্ত, জঞ্জাল নদীর জলে মিশে জলের বিশুদ্ধতা নষ্ট করছে। কৃষি জমিতে নির্বিচারে কীটনাশক ঔষধ প্রয়োগ ধীরে ধীরে মানবদেহে ব্যাপক বিষ সঞ্চার করছে। শহর নির্মাণের প্রয়োজনে বৃক্ষচ্ছেদন করে ও আমরা পরিবেশকে দূষিত করে তুলেছি।
বায়ু দূষণের প্রতিক্রিয়া
বায়ু দূষণের প্রতিক্রিয়া নানা রকম। সবজি চাষের ক্ষেত্রে বায়ুদূষণ দারুণ ভাবে ফসল নষ্ট করে, জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস করে। অতিরিক্ত বায়ু দূষণ থেকে ব্রঙ্কাইটিস, সিলিক্রিস, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি কঠিন রোগ দেখা যায়। বৃক্ষের ধ্বংস সাধনে শুধু যে মানুষের চোখ শ্যামল স্নিগ্ধতা থেকে বঞ্চিত হয় তাই নয়, পরিবেশের ভারসাম্য ও নষ্ট হয়ে যায়। পরিবেশ দূষণের কুফল সবচেয়ে বেশি ভোগ করতে হয় শহরবাসীকে। এই কলকাতা শহরেই পরিবেশ দূষণের পরিমাণ ৬৩৫ টন। শীতে কলকাতার ধোঁয়াশা ফুসফুসের পক্ষে মারাত্মক। অথচ শহরের পার্ক, উদ্যান, উন্মুক্ত প্রান্তর ক্রমশ লোপ পাচ্ছে।
বায়ু দূষণের প্রতিকার
পরিবেশ দূষণ এরই মধ্যে এমন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা মিলিতভাবে এর প্রতিকার কল্পে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। সমগ্র পৃথিবীর কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত করে তাঁরা কাজ করে চলেছেন। আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরা এতে অংশগ্রহণ করেছেন।’বিশ্ব শীর্ষ সম্মেলনে’ পরিবেশ বিজ্ঞানীরা সমবেত হয়ে এক দীর্ঘ মেয়াদী কর্মসূচি গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। দুঃখের বিষয় এই যে সম্মেলনে ও পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলি রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণের অভিলাষ এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর প্রতি পক্ষপাত দুষ্ট মনোভাব সন্দেহের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি খোলা মনে রাজনীতি নিরপেক্ষভাবে সমস্যাটির সমাধানে সবাই আন্তরিক না হন তবে সমগ্র বিশ্ববাসী কে ভাবীকালের মানবজাতির কাছে অভিযুক্ত হতে হবে। রাষ্ট্রসংঘ প্রতিবছর ৫ই জুন তারিখ টিকে ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’রুপে পালন করার আহ্বান জানিয়ে যে সচেতনতা সৃষ্টি করেছেন তা কার্যকর করতে হলে সমস্ত দেশ গুলিকে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।
পরিবেশকে দূষণমুক্ত করবার জন্য যেসব পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত সেগুলি হল কারখানা এমন স্থানে স্থাপন করতে হবে যাতে তার চারপাশে প্রচুর উন্মুক্ত জায়গা থাকে। কারখানার চিমনি নিঃসৃত ধোঁয়া ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব শিল্প আইন আছে তা যথাযথ পালন করতে হবে। উন্নত দেশগুলিতে বাষ্পীয় দূষণ ও বায়ু দূষণ প্রতিকারের নানা রকম ফিল্টার বুরুশ ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। নিষ্কাশন ও শোষণ প্রক্রিয়ার বায়ু দূষণ রোধ করা সহজতর। দূষিত বস্তুকে সঞ্চয় করে বিভিন্ন প্রণালী তে আবার কাজে লাগানো যেতে পারে। মোটরগাড়ির পোড়া তেল জনিত দূষণ পদার্থের একটি বড় অংশ একটু চেষ্টা করলেই বাদ দেওয়া কঠিন নয়। ভালোভাবে গাড়ি সার্ভিসিং বা রক্ষণাবেক্ষণ করলে পোড়া তেলের দূষণ কে শতকরা ৫০ ভাগ কমিয়ে আনা যায়। সবচেয়ে সহজ ও কার্যকর ব্যবস্থা হল গাছ লাগানো। মোটের উপর পরিবেশ দূষণের প্রতিকার দুঃসাধ্য নয়। আসলে যা প্রয়োজন তা হলো এই বিষয়ে সচেতনতা। বড়ই দুঃখের কথা এব্যাপারে আমাদের দেশে শিল্প কারখানার কর্তৃপক্ষ বিস্ময়কর ভাবে উদাসীন। সুতরাং, আইন প্রয়োগ কঠিন ভাবেই করতে হবে।
উপসংহার
ঈশ্বর একটি অম্লান সুন্দর পৃথিবীতে আমাদের প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু আমরা অশেষ সুখের আসায় তার পবিত্রতা ও সৌন্দর্য নষ্ট করে চলেছি। মানুষের গড়া সভ্যতার অন্যতম কুফল হল এই পরিবেশ দূষণ। বর্তমানের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের লোভে চিরকালের জন্য ঈশ্বরের সাজানো নিঃসর্গ সংসার নষ্ট করা আত্মঘাতী নীতি। যন্ত্রসভ্যতার যেসব বিষধর নাগিনী চতুর্দিকে বিধ্বংসী নিশ্বাস ফেলছে তাদের মধ্যে পরিবেশ দূষণ সবচেয়ে প্রাণঘাতী। দুঃখের কথা তাকে আমরাই সৃষ্টি করেছি এবং লালন করে চলেছি। এর প্রতিফল বর্তমান মানবজাতি শুধু ভোগ করছে না, অনাগত উত্তরপুরুষের জীবন ও বিপন্ন করে তুলেছে। আমরা যদি এই মুহূর্ত থেকে পরিবেশ দূষণের প্রতিকারের প্রয়াসি না হই তাহলে ঈশ্বরের সৃষ্ট নিষ্কলঙ্ক পৃথিবিকে কলঙ্কিত করার দায়ভার আমাদেরই বহন করতে হবে।