ভূমিকা
নদীমাতৃক দেশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে নদীর ঘনিষ্ঠ সংযোগ সৃষ্টি হয়েছে স্মরণাতীত কাল থেকে। এই সব দেশের জনগোষ্ঠীর কাছে প্রবহমান নদী তার জীবন, তার সুখ দুঃখের সঙ্গী, তার দেবতা। তাই নদী অববাহিকা অঞ্চল কে কেন্দ্র করেই এইসব জনগোষ্ঠীর অতীতকাল থেকে তাদের গ্রাম পত্তন করেছে, গড়েছে নগর-বন্দর, মন্দির মসজিদ আর শিক্ষায়তন। তার সভ্যতা,সংস্কৃতি তা রাষ্ট্রব্যবস্থা, তার ধর্ম জীবন সবকিছুর ওপর ছড়িয়ে পড়েছে নদীর প্রভাব।
গঙ্গার উপর নির্ভরশীলতা
ভারত নদীমাতৃক দেশ। অজস্র নদীবিধৌত এই বিশাল ভারত ভূমিতে পশ্চিমবঙ্গ অন্যতম অঙ্গরাজ্য।ভাগীরথী তথা গঙ্গা নদী পশ্চিমবঙ্গের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। অনাদিকাল থেকে গঙ্গা নদী বাঙালি জনগোষ্ঠীর জীবনধাত্রী, তাদের সুখ দুঃখের সঙ্গিনী, তাদের কাছে দেবী স্বরূপা। এই নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে কলকারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বাঙালির অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি অবনতি এই গঙ্গা নদীর ওপর নির্ভরশীল।বাঙালির সভ্যতা-সংস্কৃতির কেন্দ্র ভূমি ও এই গঙ্গা অববাহিকা অঞ্চল।
গঙ্গার উৎস
মহাবিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র এই গঙ্গা নদীর পবিত্র জলধারা কে শুধিয়েছিলন-‘ নদী তুমি কোথা হইতে আসিয়াছো?’ জলধারার কলধ্বনির মধ্যে তিনি জবাব শুনেছিলেন- ‘মহাদেবের জটা হইতে’। তাঁর কাছে গঙ্গা নদী কেবলমাত্র এক সামান্য নদী নয় সে পবিত্রতার মূর্ত প্রতীক গঙ্গার প্রাণদায়িণী দেবী। কিন্তু গঙ্গার জলধারার পবিত্রতা, শুদ্ধতা আজ ও কি অক্ষুন্ন আছে? আজ কি গঙ্গার জল তার অববাহিকার জনগোষ্ঠীর কাছে প্রাণ দায়িণী, অথবা প্রাণঘাতীনী রূপে বিরাজ করছে?
গঙ্গার গুরুত্ব
হিমালয়ের উৎস থেকে সুদীর্ঘ ২৫২৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে গঙ্গা নদী মোহনায় সাগরে পড়েছে। সমগ্র গঙ্গা অববাহিকা অঞ্চলের পরিমাণ প্রায় ৮,৬১,৪০০ বর্গ কিলোমিটার। এই সমগ্র অঞ্চলের নিকাশি জলের সিংহ ভাগ এসে পড়ে গঙ্গার বুকে। আধুনিক কৃষি ব্যবস্থায় রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। এই বিশাল অববাহিকা অঞ্চলে শিল্প-কারখানায় যেমন উন্নত, তেমনি ব্যাপক এ অঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থা। ফলে কলকারখানা থেকে যেমন আবর্জনা, রাসায়নিক নানা পদার্থের অবশেষ গঙ্গায় এসে পড়েছে। এর উপর মানুষ এবং জন্তু-জানোয়ারের বর্জ্য পদার্থ ও এসে মিশেছে গঙ্গার বুকে।ফলে গঙ্গাজল মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে উঠেছে। জলে যে পরিমাণ দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকলে জলকে পানের উপযুক্ত বলা যায় তা থাকছে না। নানা রোগের জীবাণু মিশছে জলে ।
জল দূষণের প্রকৃতি
বিজ্ঞানীদের মতে ভাগীরথী হুগলি নদীর অববাহিকা অঞ্চল অর্থাৎ সমগ্র দক্ষিণবঙ্গ (মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, হুগলি, হাওড়া, এবং ২৪ পরগনা ও মেদিনীপুর জেলা) জল দূষণের শিকার হয়েছে। প্রতিদিন এই অববাহিকা অঞ্চলে বিভিন্ন খাল-নালা, খোলা নর্দমা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রায় ২৫২ মিলিয়ন গ্যালন তরল আবর্জনা গঙ্গার জলে এসে পড়ছে। এই তরল আবর্জনার মধ্যে থাকছে মল-মূত্র এবং কৃষিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ঔষধের বিশেষ। এর মধ্যে শিল্পকারখানাগুলো প্রতিদিন যে তরল দূষণ দ্রব্য গঙ্গায় ঢালছে তার পরিমাণ ৭৭ মিলিয়ন গ্যালন। এর উপর কলকাতা বন্দরে আগত স্টিমার এবং জাহাজ কর্তৃক পরিত্যক্ত পোড়া জ্বালানি তেল ও কয়লার অবশেষ ও গঙ্গায় ফেলা হচ্ছে।গঙ্গার জল তাই আজ আর বিশুদ্ধ বা পবিত্র নয়, মারাত্মকভাবে দূষিত এবং জীবানুনাশক রূপ নিয়েছে। অববাহিকা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে নানা রোগ। দূষিত জল থেকে এসব রোগের সৃষ্টি। গঙ্গার জলের সঙ্গে মিশে রয়েছে অজৈব রোগ-জীবাণু। কলেরা, আমাশয়, আন্ত্রিক, হেপাটাইটিস ইত্যাদি রোগ মহামারীর আকার ধারণ করছে।
দূষণ রোধের উপায়
অথচ এই অববাহিকা অঞ্চলে অধিবাসীদের পানীয় জলের শতকরা ৮০ ভাগ গঙ্গার জলের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং গঙ্গার দূষণ প্রতিরোধ করার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। এর জন্য প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ। আশার কথা যে কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকার এই সমস্যা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন। গঙ্গা কে দূষণমুক্ত করার জন্য পৃথক ভাবে নানা খাতে অর্থ বরাদ্দ করা হচ্ছে। এখন এই বিষয়ে নানা রকম কাজ কর্ম ও চলছে। দূষণের হাত থেকে গঙ্গার জল বাঁচানোর জন্য কয়েকটি ব্যবস্থা নেওয়ার আশু প্রয়োজন। গঙ্গার তীরবর্তী সমস্ত কারখানা মালিকদের আবর্জনা ও তরল দূষিত পদার্থ পরিশোধনের ব্যবস্থা করতে হবে। দূষণ প্রতিরোধের ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিটি পৌরসভাকে আধুনিক পদ্ধতিতে শহরের ময়লা শোধন করতে হবে। মল মুত্রাদি এবং নর্দমা বাহিত ময়লা জল গঙ্গায় ফেলা বন্ধ করতে হবে। কৃষি ক্ষেত্র গুলিতে পরিমিত রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ওষুধ এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে যাতে এসব মারাত্মক রাসায়নিক পদার্থের অবশেষ গঙ্গার বুকে না পড়ে। গঙ্গার জল যেসব জায়গায় পানীয় হিসেবে বহুল ব্যবহৃত হয় সেসব জায়গায় আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। গ্রামাঞ্চলে প্রচার করতে হবে যাতে গঙ্গার জল ফুটিয়ে ব্যবহার করার অভ্যাস গ্রামবাসীদের মধ্যে গড়ে ওঠে। মাঝে মাঝে পরীক্ষা করতে হবে যাতে গঙ্গার জলে দ্রাব্য অক্সিজেনের ভাগ পরিমিত থাকে।
উপসংহার
এসব ব্যবস্থা ছাড়াও গঙ্গার পবিত্রতা রক্ষার্থে সর্বাগ্রে গড়ে তুলতে হবে জনসচেতনতা। বিভিন্ন দূষণ রোধক পরিকল্পনাগুলি শুধুমাত্র কাগজ কলমের গণ্ডিতে যেন আটকে না থাকে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। আমাদের কাছে গঙ্গা দূষণ প্রতিরোধ একটা বড় চ্যালেঞ্জ। গভীর মমত্ববোধ দিয়ে রক্ষা করতে হবে প্রবাহিণী গঙ্গার জল ধারা কে। আর তা না হলে ভবিষ্যতে গঙ্গার পবিত্রতা বিনষ্ট হয়ে গিয়ে তা পচা ডোবার সমতুল্য হয়ে উঠতে পারে। সকলের সক্রিয় দায়িত্বভার এবং সর্বাত্রক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে গঙ্গার জল দূষণ রোধ করা সম্ভব।