একটি নদীর আত্মকথা (Autobiography of a River)

ভূমিকা (আত্মীয়তার যোগসুত্র)

কান থাকলেই কি শোনা যায় ? মনও চাই। এই মন নিয়ে এগোও, আমার কথা শুনতে পাবে । আমি যে গঙ্গা ! তোমাদের মনের সখা, প্রাণের আত্মীয়। তোমাদের কাছ থেকে আমি পূজো নিই, আবার তোমাদেরও পুজো করি । আমার পূজাটা কিরকম জানো? সেবায়, ত্যাগে, উৎসর্গে। যারা আমাকে দেবতা ভাবে না, শুধুমাত্র বন্ধু বা মিত্রভাবে, তারাই কি আমার কম প্রিয় ? জাতি,ধর্ম,নির্বিশেষে আমি যে সকলেরই গো! আমাকে যে চায়, সে পায় । আমার ভান্ডার কে জল বা পানি বলা যা, ওয়াটার একোয়া , বলাও তা । আসলে কে কতটা কাছের ভাবছে আমাকে, আপন বা অন্তরঙ্গ জ্ঞান করছে, সেটাই আমার কাছে বড় কথা।

প্রকৃত পরিচয়, নানারূপ

আমি ভক্তের ভগবতী, আর্তের সেবিকা। পর্বতের ভৈরবী, সমভূমির জননী। আমার মৃত্যু নেই, আমি অমৃতের সন্তান, আমার জরা নেই, নেই যৌবনের অগ্রদূত। তোমরা ধারায় আসো, থাকো কিছুদিন, হঠাৎ চলে যাও। আমি কিন্তু এসেই আছি, যাই না কখনো। তোমাদের একরূপ, আমার বহু। আমি পথ যেমন, পথিকও তেমন, রথ যেমন, রথী ও তেমনি। আমি নিজে চলি, আবার অপরকে চালনা ও করি। আমি গোমুখীতে স্রোতস্বিনী, সাগর তীর্থে সমুদ্র সহোদরা, হিমালয় কল্লোলিনী, লোকালয়ে মন্দ প্রবাহিণী । আমি গঙ্গোত্রী, হরিদ্বার, প্রয়াগ, বারানসি ও নবদ্বীপে তীর্থ সলিলা। কলকাতা ও হলদিয়া বন্দর উপচার, সোনপুরে মেলা প্রহরী, কানপুর পাটনায় নগর দর্পণ।

যাত্রাপথ উপনদী ও শাখানদী

মধ্য হিমালয়ের গাড়োয়াল পার্বত্য অঞ্চলে আছে রহস্যময়’ গঙ্গোত্রী হিমবাহ। সেখান থেকেই আমার যাত্রা শুরু। গঙ্গোত্রী হিমবাহের গোমুখ নামক তুষার গুহা থেকে নদীর রুপে আমার প্রকাশ। চলার পথে হিমালয় দুহিতা কত নির্ঝরিনী রসদ যোগায় আমাকে। আত্মনিবেদনের মধ্য দিয়ে আমাকে বেগবতী করে । জাহ্নবীকে যেমন, অলকানন্দা কেও তেমনি ভুলতে পারিনি আমি। ঋষিগঙ্গা, মন্দাকিনী, নন্দাকিনী, ইত্যাদি পবিত্র নদী অলকানন্দার জল ভান্ডার। সে দেবপ্রয়াগ এ এসে আমাতে মিলল । দেবপ্রয়াগ, এরপর শিবালিক পর্বতমালা ধরে আমার অভিসার। হরিদ্বারে এসে পর্বত থেকে সমভূমিতে অবতরণ আমার, আমি দক্ষিণ বাহিনী। হরিদ্বার পেরিয়ে উত্তর ভারতের সমতল প্রান্তর ধরে আমার গতিমুখ দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। ফারুকাবাদ রামগঙ্গা যোগ দিল আমাতে, এলাহাবাদ প্রয়াগ এ মিলল যমুনা ও সরস্বতী। প্রয়াগে আমাদের এই তিনের সঙ্গমকে কেউ বলে ত্রিবেণী, আবার কেউবা মুক্তবেণী ।

প্রয়াগ বা এলাহাবাদ এর পর থেকে দীর্ঘ পথ জুড়ে একটানা পূর্ব বাহিনী আমি । আমার প্রবাহপথ গোমতী, ঘর্ঘরা রাপ্তি, গান্ডক, বাগমতী, কুশী, শোন ইত্যাদি নদীর সঙ্গে সংযোগে আনন্দ মুখর। তোমাদের বাংলা সমতলভূমিতে আমার প্রবেশ রাজমহল পাহাড় কে বেষ্টন করে। গিরিয়ার নিকট আমি দ্বিধা বিভক্ত। একটি ধারা দক্ষিণ বাহিনী, আর অন্যটি দক্ষিণ-পূর্ব অভিমুখী। দক্ষিণ বাহিনী খাড়া টি গৌড়, বহরমপুর, নবদ্দীপ, কালনা, চুঁচুড়া, চন্দননগর ও কলকাতা হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। গিরিয়া থেকে নবদ্বীপ অব্দি আমার পরিচয় ভগিরথী নামে। নবদ্বীপ থেকে সাগর অবধি হুগলি নাম আমার। চুঁচুড়ার অনতিদূরে আমার দুই শাখা নদী সরস্বতী ও যমুনার সঙ্গমস্থলে মিলিত হয়ে আরেক ত্রিবেনীর অংশীদারি আমি। এই সঙ্গমকে তোমরা বলে থাকো মুক্তবেণী। আমার দক্ষিণ পূর্ব বাহিনী ধারাটি পদ্মা নামে সুপরিচিত। এটি গেল বাংলাদেশ বা পূর্ববঙ্গের উপর দিয়ে। প্রমত্তা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রের মূল শাখা যমুনার সংযোগে আমার এই ধারাটি নিয়ত উচ্ছল– উত্তাল।

নানান সেতু

আমাকে পারাপারের জন্য কত জায়গায় কত সেতু করেছ তোমরা। কলকাতা, হাওড়া, দক্ষিণেশ্বর, ফারাক্কা, মকামা, মোগল সরাই, কাশি, এলাহাবাদ, কত আর নাম করবো! পূর্ববাংলা বর্তমান বাংলাদেশের সাজ ব্রিজ তো আমারই নিজের কাছেই একটা বিস্ময়।

অতীত ও বর্তমান

যুগে যুগে কত সম্রাজ্য গড়ে উঠেছে আমার তীরে। কত জনপদ। ফররুখাবাদ, মির্জাপুর, সপ্তগ্রাম ইত্যাদি নদী বন্দর গুলোর কথা কি তোমাদের মনে পড়ে? এখন নতুন যুগের মানুষেরা নতুন চিন্তা ভাবনায় সমৃদ্ধ হবে, চেষ্টা করবে যুগের সঙ্গে তাল রেখে নবনগর নগরীর পত্তনে, এটাই তো স্বাভাবিক। ধরো না কেনো কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল গুলোর কথা। আমার দুই তীর বরাবর শিল্পসমৃদ্ধি, তাই জনবসতির বাড়বাড়ন্ত। কিন্তু কয়েকশো বছর আগে কারখানার বদল এখানে শঙ্খধ্বনি শুনেছি! বিজলি আলোর রোশনাই এর বদলে পেয়েছি মাটির প্রদীপের সন্ধারতি! জল ভরা কলসি কাঁখে গায়ের বধু দের এখন আর তেমন দেখি না। পরবর্তীত পরিবেশে সবাই যত আধুনিক হচ্ছে, আমার সঙ্গে তোমাদের যোগসূত্র শিথিল হচ্ছে ততই। না না, দুঃখ করি না এর জন্য। এর ভাল দিকও আছে। যোগসূত্রেও দোহাই দিয়ে একদিন কত না অন্যায় কাজ না তোমরা করতে। সাগরে সন্তান বিসর্জন, আমার তীর ঘেঁষে সতীদাহের সমারোহ। গঙ্গাযাত্রা নামে তরতাজা মানুষকে হত্যার ব্যবস্থা, এগুলো একটাও কি সমর্থন করা চলে? কি জানো, তোমরা যে মা বলে ডাকো আমাকে ! তোমাদেরই দুঃখে আমার দুঃখ যে সবচেয়ে বেশি গো।

জন্ম উপাখ্যান, পুরাণিক কাহিনী

আমি নগাধীরাজ হিমালয়ের জ্যেষ্ঠ কন্যা। দেবতাদের অনুরোধে পিতা আমাকে দেবহস্তে সমর্পণ করেন। তারপর দেবতাদের সঙ্গে স্বর্গলোকে যাই আমি ।ওদিকে কপিল মুনির শাপে ৬০০০০ সন্তান হোন ভস্মীভূত। তাদের উদ্ধারকল্পে সাগর বংশোদ্ভূত ভগিরথ কঠোর তপস্যা করেন। ভগিরথ এর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে আমি স্বর্গ থেকে মর্তে অবতরণ করি এবং সেখান থেকে যাই পাতালে। স্বর্গ থেকে পতনের সময় মহাদেব আমাকে শিখে ধারণ করেন, জটায় আশ্রয় দেন। তাই আমি আসছি মহাদেবের জটা থেকে এমন বলাও অসঙ্গত নয় কিছু। যাত্রাপথে জহ্নু মুনির যজ্ঞশালা প্লাবিত করেছিলাম, তাই মুনি আমাকে নিঃশেষে প্রাণ করেন। পরে দেবতাদের অনুরোধে মুক্ত হই আমি । আমি জান্হবি আখ্যা পাই। আবার ভগিরথ এর কন্যা তুল্য আমি, তাই আমার অন্য নাম ভগিরথী।

উপসংহার

তবে যে নামেই আমায় ডাকো, আমি সেই একই ও অকৃত্রিম। প্রয়াগ ও হরিদ্বার এ কুম্ভমেলা তে যেমন , বাংলায় সাগর মেলায় তেমনি এক গঙ্গাকে নানারূপে তোমরা দেখ, নানাভাবে পাও।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts
Scroll to Top