ভূমিকা
সাধারণভাবে যেকোনো গণক যন্ত্র কে কম্পিউটার বলা যেতে পারে তবে সাম্প্রতিক কালে এর সংজ্ঞা আরো সুনির্দিষ্ট এবং ধরাবাঁধা। আজকের দিনে কম্পিউটার বলতে বোঝানো হয় ইলেকট্রনিক্স নির্ভর এমন একটি তথ্য সংগ্রহ ব্যবস্থাকে, যার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় এবং যে ব্যবস্থা বিভিন্ন তথ্য ও নির্দেশ গ্রহণ করে ও সংগ্রহ করে অতি দ্রুত বহুল জটিল সমস্যা নিখুঁতভাবে সমাধানে সাহায্য করতে পারে। কম্পিউটার ফ্রেমএর উপর সুইচ ও ভালভ অথবা ট্রানজিস্টার অথবা ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট ইত্যাদির সমাবেশ থাকে। ফ্রেম এর বিভিন্ন অংশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য টাইপরাইটার, লানি প্রিন্টার, কার্ড পাঞ্চিং মেশিন, ম্যাগনেটিক টেপ ইত্যাদি । এই অংশগুলোকে তার দিয়ে সংযুক্ত করে যে গণনামূলক একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়, সংক্ষেপে তার নাম হলো কম্পিউটার।
নানা আকারের কম্পিউটার
কম্পিউটার নানা আকারের হয়ে থাকে, হাতে গ্রহণযোগ্য অতি সীমাবদ্ধ ক্ষমতাসম্পন্ন , আবার কয়েকটি বড় ঘর জোড়া প্রভূত ক্ষমতাশালী। এক ও অবিচ্ছিন্ন হিসাবে এদের তৈরি করা যায়, আবার বিভিন্ন অংশগুলো কি আলাদা আলাদাভাবে ও রাখা যেতে পারে। শেষক্তগুলোর দূরবর্তী কোনো বিশেষ জায়গায় সঙ্গে এমন ভাবে যোগ থাকে তারা একক একটি ব্যবস্থা হিসাবে কাজ করতে সক্ষম হয় । বড় কম্পিউটারের বিভিন্ন অংশগুলো একই বাড়িতে থাকতে পারে, আবার দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকতেও অনেক সময় দেখা যায় । সেসব ক্ষেত্রে যোগাযোগের বাহন হল টেলিফোন লাইন।
ক্রিয়া কর্ম সীমাবদ্ধতা প্রোগ্রামার
কম্পিউটার সাধারন যোগ থেকে শুরু করে এমন সব জটিল গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে পারে যেগুলো হাতে-কলমে করতে হাজার হাজার স্টেপ বা ধাপ অংক কষতে হয়। কম্পিউটার কোন গণনা বা হিসাবকে কোনরূপ ভুলভ্রান্তি ছাড়াই লক্ষ লক্ষ বার একই রকম ভাবে উপস্থাপিত করার ক্ষমতা রাখে । এরা নির্দেশ অনুযায়ী বই ছেপে দিতে পারে, চিঠি লিখতে পারে, ছবি বা গ্রাফ আঁকতে পারে। এছাড়া পারে বিভিন্ন তথ্যকে সুশৃংখলভাবে সাজাতে, ফাইল খুঁজতে ,বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে তুলনা করতে এবং সর্বোপরি যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্ত নিতে। তবে কম্পিউটারের নিজস্ব কোনো চিন্তা শক্তি নেই। তাকে যা নির্দেশ দেয়া হয় তার বাইরে সে কিছু করতে পারে না। কম্পিউটারে কাজ করার জন্য বিভিন্ন নির্দেশনা যে দিয়ে থাকে তাকে বলা হয় প্রোগ্রামার। সেইসব নির্দেশ বা বিবৃতি গুলি এমনভাবে কম্পিউটারের কাছে উপস্থাপন করা হয় যাতে তার পক্ষে সেগুলোর তাৎপর্য উদ্ধার করা সম্ভব হয়। এদের উপর নির্ভর করেই সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে কম্পিউটার ধাপে ধাপে এগিয়ে যায়। নির্দেশ সমন্বিত এইসব বিবৃতির নাম প্রোগ্রাম। কম্পিউটারের আসল কাজ কর্মের সবটাই এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
এনালগ ও ডিজিটাল কম্পিউটার
সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপযোগী বিভিন্ন তথ্যকে (ডেটা) গ্রহণ করা এবং সাজানোর দিক দিয়ে বিভিন্ন কম্পিউটারের শ্রেণীবিভাগ করা যায়। এনালগ কম্পিউটার গুলি অবিরাম তথ্য সরবরাহে সক্ষম। ভোল্টেজ, রেজিস্টেন্স, চাপ এইসব কিছু সম্পর্কে নিরবচ্ছিন্নভাবে তথ্য সরবরাহ করার ক্ষমতা এরা রাখে। পেট্রোলিয়াম শিল্পের এবং নানা ধরনের ইঞ্জিনিয়ারিং কাজকর্মে এনালগ কম্পিউটার এর ব্যবহার খুবই বেশি। কম খরচে এ ধরনের কম্পিউটার সংগ্রহ করা যায় এবং এদের প্রোগ্রামিংও সহজসাধ্য । তবে এর সংরক্ষন ক্ষমতা খুবই সীমাবদ্ধ হওয়ার ফলে এবং তথ্য সরবরাহ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ নির্ভুল না হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তেমন ব্যবহার করা হয় না। অপরদিকে ডিজিটাল কম্পিউটার গুলি ১) ডেটা মজুতের ব্যাপারে বিশেষ পারঙ্গম, ২) যুক্তিনির্ভর ক্রিয়াকর্মে পারদর্শী। ৩) সরবরাহ করা ডেটাকে সম্পাদনা ও পরিমার্জন এ সক্ষম এবং ৪)অতি দ্রুত তাকে দেওয়া তথ্য গুলোর উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত বা ফলাফল পরিচালক তাঁর অভিরুচি অনুযায়ী সূক্ষাতিসূক্ষ ফলাফল পেতে পারেন । তবে এর প্রধান অসুবিধা হলো যে এটি নির্মাণ করা প্রভূত ব্যয় সাপেক্ষ এবং এর প্রোগ্রামিং ব্যাপারটিও যথেষ্ট জটিল।
ইতিহাস ইউনিভার্সাল ও ফার্স্ট জেনারেশন কম্পিউটার
কম্পিউটার কোন ব্যাক্তি বিশেষের আবিষ্কার নয় । বিগত ১৫০ বছরের অধিককাল ধরে বহু মানুষএর অসংখ্য আবিষ্কার ও ভাবনাচিন্তার ফলশ্রুতি এতে আছে। এদের মধ্যে সবার আগে চার্লস ব্যাবেজ এর নাম। তিনি আঠার ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে একটি অটোমেটিক মেকানিক্যাল ক্যালকুলেটর গড়বার জন্য সচেষ্ট হন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চেপে ছাড় দেওয়া বা ছিদ্র করার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রাদি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপকভাবে চালু হয় । ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে হাভার্ডে হাওয়ার্ড আইকিন নামে এক ব্যক্তি আই.বিএ.ম এর কাছে প্রস্তাব রাখেন, এমন একটি যন্ত্র নির্মাণ করা হোক যে আপনার থেকে তার ক্রিয়াকর্ম কে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং গণনার কাজও করবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে । আইকিন চেয়ে ছিলেন , এই যন্ত্র কে নির্দেশ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক বিদ্যুৎচালিত যান্ত্রিক পদ্ধতির মাধ্যমে। ইউনিভার্সাল অটোমেটিক কম্পিউটার হল সাধারণ কাজকর্মে ব্যবহৃত প্রথম বৈদ্যুতিক কম্পিউটার। এর থেকেই ফার্স্ট জেনারেশন কম্পিউটার এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল আইবিএম ৬৫০। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বৈজ্ঞানিক উভয় প্রকার কাজকর্মেই এদের ব্যবহার শুরু হয়।
সেকেন্ড থার্ড ও ফোর্থ জেনারেশন
সেকেন্ড জেনারেশন কম্পিউটারের ট্রানজিস্টর স্থান পেল। এদের সার্কিট হল ফার্স্ট জেনারেশন এর তুলনায় অনেক ছোট। এছাড়া এরা তাপ বিকিরণ করত প্রথমোক্ত দের তুলনায় অনেক কম পরিমাণে। এটা পরিচালনা করতে অপেক্ষাকৃত কম শক্তি দরকার হয়। সর্বোপরি এদের কাছ থেকে অতি দ্রুত কাজ পাওয়া গেল এবং এরাও হয়ে উঠল বিশেষ নির্ভরযোগ্য। সেকেন্ড জেনারেশন কম্পিউটার এর মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করে আইবিএম ১৪০১। দু ধরনের সেকেন্ড জেনারেশন কম্পিউটার প্রচলিত হয়েছিল, একটি ব্যবহৃত হতো বৈজ্ঞানিক কাজকর্মে, অপরটি ব্যবসা-বাণিজ্যে।
এদের মধ্যে ম্যাগনেটিক টেপ ব্যবহৃত হতে দেখা গেল। থার্ড জেনারেশন কম্পিউটার এর ক্ষুদ্রাকার সিলিকন বাক্সে ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট থাকলো। এরা দামের দিক থেকে সস্তা হলো এবং এছাড়া নির্ভরযোগ্যতার দিক থেকেও সেকেন্ড জেনারেশন কে ছাড়িয়ে গেল অনেক দূর। দ্রুত কাজ করার ক্ষেত্রে এবং ব্যাপক ক্ষমতা নিয়ে কাজে লাগাবার পূর্ববর্তী যুগের কম্পিউটারের তুলনায় আরও অনেক উন্নত হল। ফোর্থ জেনারেশন কম্পিউটার এর প্রয়োগ দেখা গেল ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে। নতুন যুগের উন্নত ধরনের ইলেকট্রনিক প্রযুক্তি বিজ্ঞান এর সহায়তায় এদেরকে আগের যুগের কম্পিউটারের তুলনায় আরো দ্রুত আরো ছোট করে তৈরি করা সম্ভবপর হলো।
মাইক্রো ও ফিফথ জেনারেশন অপটিক্যাল
আবার এদের তুলনায় আকারে ছোট মাইক্রোকম্পিউটার। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে থেকে এদের প্রয়োগ চলে । এই শ্রেণীর কম্পিউটার এর সবচেয়ে বড় সুবিধা, খুবই স্বল্প ব্যয়ে এদের সংগ্রহ করা সম্ভব । ফলে এদের ব্যবহার বেড়ে চলল অতি দ্রুত গতিতে। কলকারখানায়, অটোমেশনের ক্ষেত্রে মাইক্রোকম্পিউটার বহুল পরিমাণে কাজে লাগতে দেখা গেল। এছাড়া ওজনে হালকা হয় খুব সহজেই এদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হল । এদিকে হাজার ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে থেকে শুরু হয় ফিফ্থ জেনারেশন কম্পিউটার এর প্রয়োগ । পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনার কাজে ব্যাপকভাবে এদের ব্যবহার চলতে থাকে। দেখতে দেখতে সৃষ্টি হয় এমন এক শ্রেণীর পরিচালক যারা কম্পিউটার প্রয়োগ সম্পর্কিত কিছু কলা-কৌশল অধিগত করে । এই যন্ত্রটি কে দৈনন্দিন কাজে সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করতে পারেন । ১৯৮৯ এর গোড়ার দিকে হামবোল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এক নতুন ধরনের কম্পিউটার নির্মাণ করেন। বিদ্যুৎ এর পরিবর্তে এরা পরিচালিত হবে আলোর দ্বারা। এদের বলা হচ্ছে অপটিকাল কম্পিউটার। আলোর সাহায্যে চালিত এসব কম্পিউটার। বিদ্যুৎ চালিত কম্পিউটারের তুলনায় অধিক নির্ভরশীল হবে এবং কাজ করবে অপেক্ষাকৃত দ্রুত।
কম্পিউটার পরিচয়
কম্পিউটারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জিনিসগুলির কয়েকটি সাংকেতিক নাম আছে। যেমন ইনপুট সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট, আউটপুট ডিভাইস ইত্যাদি । ইনপুট বলা হয় সেই বিশেষ ব্যবস্থাকে যার মাধ্যমে প্রোগ্রাম স্টেটমেন্ট এবং ডেটা সরবরাহ করে কম্পিউটারে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয় । সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট কে এক কথায় বলা যেতে পারে কম্পিউটারের হৃৎপিণ্ড। এই অংশটি তুলনা করে, হিসেব কষে, সিদ্ধান্ত নেয়, নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে নির্দেশ দেয়। এর তিনটি প্রধান অংশ হলো লজিক্যাল এন্ড এরিথমেটিক ইউনিট, কন্ট্রোল ইউনিট এবং প্রাইমারি মেমোরি বা স্টোরেজ ইউনিট। আউটপুট ডিভাইস বলতে ঠিক ইনপুট ডিভাইসের মতো মানুষও যন্ত্রের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের কিছু উপকরণ কে বোঝায়। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে কম্পিউটার প্রদত্ত সিদ্ধান্তগুলো বা হিসাবগুলো সবাইকে জানাবার উপযোগী করে রেকর্ড করা হয়।
সুপার কম্পিউটার
১৯৮৯ এর ২৫ শে মার্চ ভারতে প্রথম সুপারকম্পিউটার ক্রে এক্স-মে-পি কে জাতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। এই কম্পিউটার আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রদান এবং কৃষি সংক্রান্ত কাজকর্মে নানাভাবে সাহায্য করছে । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর নির্মাতা। সুপার কম্পিউটার বাবদ ভারতের ব্যয় হয়েছে 15 কোটি টাকা।
উপসংহার
আজ আর কল্পনা করতে বাধা নেই যে আগামী দিনে কম্পিউটার হয়তো আরও দ্রুত কাজ করতে পারবে । হয়তো বা আরো বেশি নির্ভর করা যাবে তার উপর। ভবিষ্যতে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এর কাজ ও নিশ্চয়ই আরো সহজ হবে এবং শুধুমাত্র ইংরেজির মত ভাষার মাধ্যমে নির্দেশনা না দিয়ে, মৌখিক নির্দেশ এর মাধ্যমে ও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে। তবে এ ব্যাপারে সমস্যা ও যথেষ্ট। মানুষ যন্ত্রের উপর অতিরিক্ত নির্ভর করতে গিয়ে না যান্ত্রিক হয়ে পড়ে।