বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ( Cultural Heritage of Bengal)

সংস্কৃতি হল কালচার বা জাতির চিৎপ্রকর্ষের ব্যঞ্জনাময় অভিব্যক্তি। জাতির যুগ যুগান্তরে স্বপ্ন ও সাধনা তার ভাব লোকের গৌরব সমুন্নতি তিল তিল সঞ্চয় করে সৃষ্টি হয় সংস্কৃতির ধারা। সমগ্র জাতির চিন্তা ধারা ভাবধারা ও কর্ম ধারার গৌরবময় প্রতিচ্ছবি হলো তার সংস্কৃতি।

“কমল হীরের পাথরটাকেই বলে বিদ্যে আর ওর থেকে যে আলো ঠিকরে পড়ে তাকেই বলে কালচার । ” – রবীন্দ্রনাথ

ভূমিকা:

সংস্কৃতি হল কালচার বা জাতির চিৎপ্রকর্ষের ব্যঞ্জনাময় অভিব্যক্তি। জাতির যুগ যুগান্তরে স্বপ্ন ও সাধনা তার ভাব লোকের গৌরব সমুন্নতি তিল তিল সঞ্চয় করে সৃষ্টি হয় সংস্কৃতির ধারা। সমগ্র জাতির চিন্তা ধারা ভাবধারা ও কর্ম ধারার গৌরবময় প্রতিচ্ছবি হলো তার সংস্কৃতি। সংস্কৃতি জাতির সর্ববিধ বিষয়ে সর্বাঙ্গীণ উন্নতি চরমতম পরিণাম ফল। সংস্কৃতি সমগ্র সমাজের যৌথ সৃষ্টি। তার সুবর্ণ তারেই বেজে ওঠে জাতির হৃদস্পন্দনের কল্লোলিত মর্মরধ্বনি।

সংস্কৃতির প্রকৃত পরিচয়:

সংস্কৃতিতেই জাতীয় প্রাণময়তার প্রকাশ। পোশাকে পরিচ্ছদে খেলাধুলার আমোদ-প্রমোদে তাই প্রতিমুহূর্তে তার বিচিত্র সংস্কৃতি ধারা রচনা করে চলেছে সৃষ্টি করে চলেছে সংস্কৃতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রবহমানতা। যে জাতির সংস্কৃতির রূপান্তর নেই, নেই ক্রমবিবর্তন, তার সংস্কৃতি মৃত, সেই জাতীও মৃত। কারণ সংস্কৃতির মধ্যেই নিয়ত ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয় সমগ্র জাতির প্রাণস্পন্দন।

বাংলার সংস্কৃতির মূল সূত্র:

বাংলা সংস্কৃতির সৃষ্টি ও বিকাশের মূলে রয়েছে তার অফুরন্ত প্রাণপ্রাচুর্য। আর্য সংস্কৃতির সঙ্গে তার নিবিড় যোগ বন্ধন থাকা সত্ত্বেও তা আপন স্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল, ‘আপনাতে আপনি বিকশিত’। সর্বভারতীয় প্রাণ গঙ্গা যেমন বাংলার কোমল মৃত্তিকা স্পর্শ করে পদ্মা ও ভাগীরথী নাম- পরিগ্রহ করেছে, তেমনি সর্বভারতীয় সাংস্কৃতিক ধারা বাঙালির সৃজনশীলতার অনন্যতায় স্বতন্ত্র বাঙালি সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। কাজেই কেবল অস্ট্রিক -দ্রাবিড় গোষ্ঠীই নয়, এখানে আর্য এবং শক হূনদল পাঠান মোগল এক দেহে লীন। সর্বশেষে এসেছে প্রবল ইংরেজ। বাঙালি সকলকে গ্রহণ করেছে। সকলের সংস্কৃতির তিল-তিল সোনা সংগ্রহ করে সে রচনা করেছে তার সংস্কৃতির অনবদ্য তিলোত্তমা মূর্তি। এইখানেই বাঙালি সংস্কৃতির অনন্যতা। সে সর্বভারতীয় সংস্কৃতির কোমল মণির ওপর সংযোজিত করেছে তার স্বাতন্ত্র্যের অনুপম দ্যুতি। বাঙালি সংস্কৃতি তাই সর্বভারতীয় সংস্কৃতির উপধারা হয়েও স্বতন্ত্রের অনন্যতায় পৃথক স্বতন্ত্র।

ধর্ম : বঙ্গ সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র:

বঙ্গ সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র হলো তার ধর্ম। তাকে অবলম্বন করে বিকশিত হয়ে উঠেছে তার সংস্কৃতির এক বিশাল ধারা। সেই ধর্ম লৌকিক ও পৌরাণিক বিশ্বাসের সমন্বয়ে রচিত। লৌকিক দেব দেবী ও পৌরাণিক দেব দেবী এখানে যুগ যুগ ধরে পরস্পরের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হওয়ার ফলে কখনো কখনো অভিন্ন হয়ে পড়েছেন। হাজার বছর ধরে তাঁরা বাঙালির সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। চন্ডী, ষষ্ঠী, মনসা ,ধর্ম ঠাকুর এঁদের নিয়ে রচিত হয়েছে নানা মূর্তি, নানা চিত্র এবং লোক সাহিত্যের বিশাল ধারা।

লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি প্রতিচ্ছবি:

বাংলার লোকসাহিত্য তার লোকসংস্কৃতির জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। শিবায়ন মঙ্গলকাব্যে, যাত্রা পাঁচালী ও কবি গানে, বাউল -ভাটিয়ালি- জারী- সারী -মুর্শিদা টুসু- ভাউলিয়া ও কীর্তনের গানে বেঁচে আছে বাঙালির অফুরন্ত প্রাণসত্তা। ফুল্লোরা -খুল্লনা ,বেহুলা- লখিন্দর, কালু-লক্ষা, মেনকা- উমা ,মহুয়া- মলুয়া, লীলা- কঙ্ক, সোনাই- কাজল রেখা—- এদের আশ্রয় করে বাঙালি যত কেঁদেছে তার দ্বিতীয় নজির আর কোন জাতির ইতিহাসে নেই। সেই রূপ সৃষ্টির অপূর্ব মায়া কাজলে অপরূপ হয়ে উঠেছে তার ব্রত কথা, রূপকথা ও ছেলেভুলানো ছড়া গুলি। সংস্কৃতির স্বর্ণ পাত্রে পরিবেশিত হয়ে এগুলি প্রবাহিত হয়ে এসেছে যুগ থেকে যুগান্তরে ঘাটে।

কারুশিল্পে বঙ্গসংস্কৃতি অম্লান স্বাক্ষর:

বঙ্গ সংস্কৃতির অম্লান সাক্ষর রয়েছে তার গৃহনির্মাণ পদ্ধতিতে ,তার স্থাপত্যে, ভাস্কর্যে ও মৃৎশিল্পে। বাঙালি কারিগরদের নির্মিত আট-চালা ,কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল, কালীঘাটের অঙ্কিত পট, বাংলার মেয়েদের আঁকা আলপনা, নকশি কাঁথা আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাছাড়া হাঁড়ি- কলসি, বাসন-কোসন, ও কাপড়ের সূক্ষ্ম শিল্পকর্মে, স্বর্ণকার দের জড়োয়া শিল্পে , খাট পালঙ্ক ও শীতলপাটি মাদুর তৈরিতে বাঙালির সংস্কৃতি রয়েছে স্বাতন্ত্র্যের স্বাক্ষর। তার ঢাকে ,ঢলে, মৃদঙ্গে নিত্য ধ্বনিত হয় তার সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য ও অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য। বাঙালির মতো ঢোল বাজাতে পৃথিবীর কোন জাতি পারে না।

বঙ্গ সংস্কৃতির রূপ-রূপান্তর:

বাঙালি সংস্কৃতির জন্ম প্রাগৈতিহাসিক কালে। অস্ট্রিক- দ্রাবিড়- ভোট- ব্রহ্ম সংস্কৃতির ওপর ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের প্রভাবে যে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ দ্বাদশ শতকের তার উপর এসে পড়ে মুসলমান সংস্কৃতির— সুফি সাধনার প্রভাব। আজ বাংলার সংস্কৃতি তো হিন্দু মুসলমানের যৌথ সম্পত্তি। তারপরও অষ্টাদশ শতকে ইংরেজি সভ্যতাকে বাঙালি বাঁধে নিবিড় যোগ বন্ধনে।

অপসংস্কৃতির আক্রমণ : বঙ্গ সংস্কৃতির সংকট:

আজ বঙ্গসংস্কৃতি এসে দাঁড়িয়েছে চরম সংকটের মুখে। রাজনৈতিক চক্রান্তে আজ সোনার বাংলা দ্বিধা-বিভক্ত। বাংলার প্রাণ প্রবাহিণী গঙ্গা-পদ্মা হয়েছে দ্বিধা বিভক্ত। আজ দেশবিভাগের সীমারেখার ওপারে কাঁদছে মহুয়া- মলুয়া-কাজলরেখারা, এপারে কাঁদছে ফুল্লরা -বেহুলা- খুল্লনারা। ওপারে ভাটিয়ালি এপারে বাউল। তার ওপর আজ এসে পড়েছে হিন্দি সিনেমার আক্রমণ এবং প্রবল মার্কিনী প্রভাব। এইভাবে অপসংস্কৃতির আক্রমনে আজ ঘনীভূত হয়েছে বঙ্গসংস্কৃতি চরম সংকট। যা অবশিষ্ট ছিল বিদ্যুতিক মাধ্যম ও মার্কিন সংস্কৃতি আক্রমণের তা অবলুপ্তপ্রায়। ভিতরের ও বাইরের আঘাতে বাংলার সংস্কৃতি আজ বিপর্যস্ত।

উপসংহার:

যেখানে আগমনী বিজয়ার গানে একদা মর্মরিত হত বাংলার আকাশ-বাতাস ,যেখানে শুকায় পদ্ম বহুদিন বিশালাক্ষী যেখানে নিরব সেইখানে একদিন শঙ্খমালা চন্দ্রমালা মানিক মালার কাঁকন বাজিত, আহা কোনোদিন বাজিবে কি আর। আশা করব, নব তর রুপ রূপান্তরের মধ্য দিয়ে জন্মলাভ করবে আগামীকালের প্রাণোচ্ছল ,উজ্জ্বল বঙ্গসংস্কৃতি ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts
Scroll to Top