প্রবন্ধ সংকেত: ভূমিকা – সময় অনন্ত, জীবন ক্ষুদ্র, তাই সময় মূল্যবান – সময়ের সফল ব্যবহার – জীবন মহৎ কর্মের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ – মানুষের দুঃখ মোচনেই জীবনের সার্থকতা – উপসংহার
হায় রে হৃদয়,
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়
নাই নাই ,নাই যে সময়।’
– রবীন্দ্রনাথ
ভূমিকা:
মর্তের মানুষের চিরন্তন বাণীহারা কান্না-‘ নাই নাই, নাই যে সময়।’
অনন্ত -প্রসারিত সময় যাত্রা-পথ ।পৃথিবীর ‘পথিক’ মানুষ সময়ের সেই পথ-রেখা অগ্রসর হয়। অনাদি, অনন্ত সময়ের মতো মানব -জীবন যদি অন্তহীন হতো ,তাহলে দুঃখ থাকতো না মানুষের। সময় নিরবধি কিন্তু মানব- জীবন সংক্ষিপ্ত। এইখানে গরমিল। মানুষ চায় তার সংক্ষিপ্ত জীবনায়তনের মধ্যে বহুতর কর্মের উদযাপন। কিন্তু সময় তা মঞ্জুর করে না। কর্ম -উদযাপনের পূর্বেই তার বিদায়ের ডাক এসে পড়ে। নীরবে নিঃশব্দে পৃথিবী থেকে চলে যেতে হয়। মানুষের কাছে
তাই সময় অমূল্য ধন। মুহূর্তের জন্যেও কোথাও সে স্থির থাকে না ,কারও জন্যে সে অপেক্ষা করে না ।সময়ের সেই অন্তহীন প্রবাহে মানুষও ছুটে চলেছে জন্ম থেকে মৃত্যুর অভিমুখে।
সময় অনন্ত কিন্তু জীবন ক্ষুদ্র তাই সময় মূল্যবান:
সময় অনন্ত কিন্তু জীবন সীমাবদ্ধ। তার এক প্রান্তে জন্ম, অন্য প্রান্তে মৃত্যু। এই জন্ম ও মৃত্যুর শাসনের জীবন সদা -সংকুচিত। মানুষ চায় অন্তহীন সময়ের মতো অন্তহীন জীবন। কিন্তু পায় না। মানব জীবনের চরম ট্রাজেডি এখানেই ।মানুষের অস্তিত্বের দুই প্রান্তেই ঘুম ,ঘুমের মতো অন্ধকার। মাঝখানে শুধু একটুখানি চোখ মেলে চাওয়া জীবন।
সময়ের সফল ব্যবহার:
আমাদের পরম সৌভাগ্য যে ,আমরা এই মানব -জন্ম পেয়েছি। এর পূর্বে পৃথিবীতে মানুষ রূপে জন্মেছিলাম কিনা জানা নেই। এরপরে মানুষরূপে কোন পিতা-মাতার কোলে জন্মাবো কিনা ,তাও জানি কাজেই, এ যাত্রায় যে মানব- জন্ম পেয়েছি, সে আমাদের পরম সৌভাগ্য। সৌভাগ্য -লব্ধ এই মানব জন্ম ও মানব -জীবনকে সফল করে তোলা চাই। কাজেই, এ জীবনে এমন কিছু করা চাই, যাতে মানুষের কল্যাণ হয় এবং সেজন্য মানুষের মনে আমাদের স্মরণীয় তার দাবি প্রতিষ্ঠিত থাকে।
জীবন মহৎ কর্মের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ:
কাজেই, সময়ের শাসনে গন্ডিবদ্ধ যে জীবন ,তার সার্থকতা চাই। তার সার্থকতার জন্য চাই জীবনের নিত্যনতুন কর্মনিষ্ঠা। জীবনের মূল্যবোধহীন মানুষ বড় নির্বোধ ।দুর্লভ জীবন যে কত মূল্যবান, সে উপলব্ধি করতে পারে না। আবার, এক শ্রেণীর মানুষ আছে, যারা আত্ম সুখের জন্য পশুর মতো সারাজীবন খেটে অবশেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে । সে জীবনও অর্থহীন- সহস্র কীটপতঙ্গের জীবনের মতো ব্যর্থ ।মানব- জীবন অনেক মহৎ – মহৎ উদ্দেশ্যেই তার সৃষ্টি ।কাজেই, মানব জন্মের ঘরে এসে মানুষ যে মহৎ জীবন পায় বাঁচার জন্য, তা দিয়ে মহৎ কর্মের উদযাপনেই তার সার্থকতা ।জীবন মহৎ কর্মের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ।সে পৃথিবীতে শুধু বাচাঁতেই আসেনি, এসেছে মহত্তর কিছু করে পৃথিবীর মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্যে। কিন্তু অজ্ঞানতার তিমিরান্ধমানুষ তা বুঝতে পারে না সেজন্য সে হয় আলস্যে জীবন কাটিয়ে দেয়, কিংবা আত্ম-সুখলাভের ঘৃণাবর্তের মধ্যে নিজেকে নিক্ষেপ করে যাপন করে স্বার্থপিপাসি আহারান্বেষী এক জানোয়ারের জীবন। সেই জীবনের প্রতি ধিক্কার জানিয়ে কবি বললেন:
স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ
বৃহৎ জগৎ হতে, সে কখনো শেখেনি বাঁচিতে।’
কাজেই , স্বার্থমগ্ন তার জীবন প্রকৃত জীবন নয় । জীবনের এক প্রকার অপচয়।
মানুষের দুঃখ মোচনেই জীবনের সার্থকতা:
মানুষের জীবনের মূল্যায়ন আয়ুষ্কালের বছরের সংখ্যার সমষ্টিতে নেই ,আছে শুভকর্ম উদযাপনে পবিত্র পরিধির মধ্যে। পৃথিবীর মহাপুরুষগণের জীবনের কক্ষপথ তাই শুভ কর্ম উদযাপনের অভিমুখে প্রসারিত। সেই পথে যাত্রা করেছিলেন ভগবান বুদ্ধ ,যীশুখ্রীষ্ট, জরাথুস্ট্র ,কনফুসিয়াস ,চৈতন্য এবং এযুগের স্বামী বিবেকানন্দ। এই দুঃখময় পৃথিবীতে মানুষের দুঃখের অন্ত নেই। তাই আজ নিখিল বিশ্ব ক্রন্দনাতুর। তাদের কান্না ঘোচাতে হবে, মুছে দিতে হবে তাদের বেদনার অশ্রুধারা।
জীবন তো সেইজন্যেই নিবেদিত। বিশ্বব্যাপী ক্রন্দন- কাতরানি দূরে ঠেকিয়ে রেখে আত্মসর্বস্বতার চারিদিকে সমুচ্চ প্রাচীর তুলে দিয়ে তার মধ্যে বাস করার মধ্যে সুখ নেই। সুখ আছে পরের দুঃখ- মচনের মধ্যে।’ কিন্তু সেই ‘deeds’ ‘noble ‘ হওয়া চাই।
উপসংহার:
কাজেই, কর্মই সময়ের সদ্ব্যবহারের পরিমাপের একমাত্র মাপকাঠি।য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কে কত মহৎ এবং মূল্যবান কাজ সম্পন্ন করতে পারে ,তা দিয়েই তার সাফল্য বিবেচিত হয়। তাই জীবনে মানুষ কতদিন বেঁচেছে, তা বড় কথা নয় ;সে জীবনে কত মহৎ কর্ম সম্পাদন করেছে এবং সেইসব কর্মানুষ্ঠানের ফলে মানব -সমাজ কতখানি উপকৃত হয়েছে, তাই-ই তার সাফল্যের বিচারক ।স্বার্থল্যেশহীন কল্যাণপূত কর্মেই মানুষের জীবনের চরম সার্থকতা।