ভূমিকা
হবি বলতে আমরা তাকেই বুঝি যার মাধ্যমে আমরা এক অনাবিল আনন্দ অনুভূতি লাভ করি। শখের বিস্তৃত পরিধিতে গরীব -বড়লোক শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলেই সামিল। কোনো রকম হবি নেই এমন মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে খুবই নগণ্য। তবে শখের সঙ্গে পেশার পার্থক্য অবশ্যই আছে। কারণ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, একজন মানুষ হয়ত বিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণার কাজে রত কিন্তু তার শখ সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি হয়ত কবিতা লিখতে ভালোবাসেন। মানুষের এই হবি বা শখ কখনই কোনো যুক্তি তর্কের ধার ধারে না। কাজেই এর মাধ্যমে আমাদের মনে সুপ্ত সম্পূর্ণ পৃথক মানব সত্তার সন্ধান মেলে।
শ্রেণী বিভাজন
মানুষের শখের পরিধি সীমা এত বিচিত্র যে তার শ্রেণী বিভাজন করা সম্ভব নয়। এ প্রচেষ্টা করলে সে তালিকা বড়ো দীর্ঘ হয়ে যাবে। তবুও মোটামুটি বলা যেতে পারে মানুষের প্রচলিত শখ গুলির মধ্যে অন্যতম বাগান করা, ডাকটিকিট সংগ্রহ, প্রাচীন মুদ্রা সংগ্রহ ইত্যাদি। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সভ্য দেশেই জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যেই এই হবি দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত। ডাকটিকিট সংগ্রহ যাদের নেশা তাদের বহু সংস্থাও দেখা যায়। এই সমস্ত সংস্থার মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ডাকটিকিটে বিনিময় প্রথা প্রচলিত রয়েছে। বর্তমানে এ ধরনের সংস্থায সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। শখের জনপ্রিয়তা কত ব্যাপক তার প্রমাণ এর সদাচঞ্চল ব্যস্ততার মধ্যে। আরো একটি বহু প্রচলিত হবি হল বাগান তৈরি করা। এটিও বহু প্রাচীন ও প্রচলিত জনপ্রিয় শখ। বাগানে নতুন ফুল গাছ লাগানো, টবে নতুন চারা তৈরি করা, বিভিন্ন রকম ফুল গাছ লাগানো ও তাদের পরিচর্যায় অনেকের দিনের অনেকটা সময় ব্যয় হয়। কারো শখ হল বহু প্রাচীন মুদ্রা সংগ্রহ। অনেকে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রাচীন মুদ্রা ক্রয় করে থাকেন। তাঁদের কাছে এগুলি বহু মূল্যবান সম্পদ। প্রাচীন শিল্পকর্ম সংগ্রহ করা অনেকের হবি। বিভিন্ন সময়ে লৌকিক শিল্পকর্ম, বিখ্যাত চিত্রকরদের আঁকা ছবি সংগ্রহ, বহু প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ ইত্যাদি সবকিছুতেই শখের আওতায় আনা যেতে পারে। তবে এই সকল হবি অনেক ক্ষেত্রেই ব্যয়বহুল। বিভিন্ন জাতের নানা রকম পাখি পোষা, নানা জাতের কুকুর পোষা ও বহু প্রচলিত শখ। এর মাধ্যমে অনেকে খুঁজে পান অনাবিল এক আনন্দের স্বাদ।
মানব চরিত্রের ভিন্ন সত্তা
প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিগত হবি বা শখের মাধ্যমে ব্যক্তি মানুষের একটি অন্য সত্তাকে আমরা আবিষ্কার করতে পারি। এর প্রতি আন্তরিকতা ও ভালোবাসা যদি না থাকে তবে কখনই এটি পূর্ণতা পায় না। যে লোকটিকে আমরা সমাজ জীবনে অত্যন্ত রুক্ষ প্রকৃতির বলে জানি, দেখা যায় সে ব্যক্তিই হয়তো ফুলগাছ ভালোবাসেন। বাগান করাই তার শখ। গাছের প্রতিটি ডাল ও কুঁড়িকে তিনি সস্নেহ দৃষ্টিতে দেখেন। মানুষের সৌন্দর্য বোধ,রুচির পরিচিতি আমরা পাই হবির মাধ্যমে।শখ মানুষকে শিক্ষা দেয় শৃঙ্খলা বোধ, চেতনা সৃষ্টির। জেগে ওঠে নিত্যনতুন সৃষ্টির নেশা। নব সৃষ্টির আনন্দ আমরা উপভোগ করতে পারি শখের রূপায়ণের মাধ্যমে।
শখের মাধ্যমে জ্ঞান লাভ
শখের চরিতার্থতার মাধ্যমে আমাদের অবচেতন মনে গড়ে ওঠা কামনার নিবৃত্তি ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান লাভ ও সম্ভব হয়। উদ্যান রচনা শুরু করলে তাঁর প্রতি আকর্ষণ জন্মালে, যদি তাকে আমরা ভালবাসতে পারি তাহলে গাছ, ফুল, ফল, সম্পর্কে অনেক তথ্য ও জ্ঞান লাভ হয়। এদের বংশবৃদ্ধি, বেড়ে ওঠা সম্পর্কে জানার অদম্য আগ্রহ সৃষ্টি হয়। যেকোনো ডাকটিকিটের ছবি দেখে সে দেশের সামগ্রিক ইতিহাস, শিক্ষাদীক্ষা, উন্নয়নের কথা জানা যায়। আবার মুদ্রার মাধ্যমে জানা যায় সে দেশের শিল্প কর্ম সম্পর্কে। তাই সকলকেই এক বাক্যে স্বীকার করে নিতে হয় শখের দ্বারা আমাদের অবদমিত কামনা-বাসনার চরিতার্থ তার সঙ্গে সঙ্গে নিত্য নতুন তথ্য ও আবিষ্কার করা যায়।
শখ সম্পর্কে কবি দৃষ্টি
শখ মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়। বিভাজনের মাধ্যমে বহুলত্বের দ্বারা শখের আবেদন মিথ্যে হয়ে যায়। এ যেন মানুষের এক সহজ খেয়াল যুক্তির প্রাধান্যে যাকে কখন ও বাঁধনে আটকে রাখা যায় না, এর একটা উদ্দেশ্য আছে, লক্ষ্য আছে, কিন্তু চলার পথের স্থিরতা নেই, এ চলে উদ্দেশ্যহীন পথে একে শাসনের বন্ধনে বাধা যায় না। একে জড়িতে হলে প্রয়োজন ভালোবাসার বন্ধন। শখ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য “একটা প্রয়োজনের ইচ্ছা আর অন্যটা অপ্রয়োজনের ইচ্ছা। একটা যাহা না হলে কিছুতেই চলে না তার ইচ্ছা এবং অন্যটা যা না হলে অনায়াসেই চলে তাহার ইচ্ছা। আশ্চর্য এই যে, মানুষের মনে এই দ্বিতীয় ইচ্ছাটার শক্তি এত প্রবল যে, সে যখন জাগিয়া ওঠে তখন সে এই প্রথম ইচ্ছাটাকে একেবারে ছারখার করিয়া দেয়।”
উপসংহার
মানুষের শখের জগৎটি সম্পূর্ণই তাঁর ব্যক্তিগত এক স্বতন্ত্র জগৎ। এই জগতে সে এক অপার্থিব আনন্দের সন্ধানে প্রচেষ্টারত। রোজকার ধরা বাঁধা এক ঘেয়ে যান্ত্রিক জীবন থেকে অবকাশ পাওয়া যায় শখের জগতে। পাওয়া যায় বন্ধনহীন মুক্ত জীবনের স্বাদ। নিজের নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব কাটাতে অভাব-অনটন, সুখ-দুঃখ ভরা এ জীবনে শখের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কর্মব্যস্ত মানুষকে বিধি-বিধানের সীমারেখার বাইরে একান্ত নিজস্ব পৃথিবীতে সম্পূর্ণ পৃথকভাবে চিহ্নিত করে শখ। গড়ে তোলে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে এক সম্প্রীতির বন্ধন। আপাতদৃষ্টিতে বিচার করলে হবি হয়ত বা খুব সামান্য জিনিস। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর মাধ্যমেই একজন মানুষের মানবীয় সত্তার সত্যরূপ প্রকাশ সম্ভব। এ থেকেই আমরা জানতে পারি মানব অন্তরাত্মার যথার্থ রূপকে।