ভূমিকা:
‘মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিতো যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহা শব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে ,মানবতার অমর আলোক কালো অক্ষরে শৃংখলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে। গ্রন্থাগার সম্বন্ধে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের এ উক্তি ভাগবতী উক্তির মতো শাশ্বত ও চিরসত্য।
গ্রন্থাগার কি ?
জ্ঞান সমুদ্রের প্রতিটি তরঙ্গ বিক্ষোভকে কালো অক্ষরের বাঁধনে, ভাষার আধারে যে বেঁধে রাখে সে হলো গ্রন্থ। গন্থের আগার বা গ্রন্থ রাখার ভান্ডার হল গ্রন্থাগার। গ্রন্থাগারের যাবতীয় জ্ঞান, বিজ্ঞান,দর্শন, ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য, সভ্যতা, সংস্কৃতি বিষয়ক নানা গ্রন্থ সংগ্রহ করে পরম যত্নে রাখা হয়। ফলে গ্রন্থাগারে সঞ্চিত থাকে চিন্তাশীল মনীষীদের চিন্তাজাত অমূল্যসম্পদ।
গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা:
সুদূর অতীতের অতল গর্ভে যা চির নিমজ্জিত তার স্বরূপ ও জীবন্ত চিত্র বর্তমান মানুষের মনের দ্বারে হাজির করতে পারে গ্রন্থাগার। সে রচনা করে অতীত -বর্তমান- ভবিষ্যৎ এর মধ্যে এক অপূর্ব মিলন- সেতু। সাহিত্য- সভ্যতা- সংস্কৃতির মধ্যে আদর্শের যে প্রকাশ, ব্যক্তি-জীবনের যে প্রতিফলন ,জাতীয় জীবনের যে অভিব্যক্তি, বিভিন্ন চরিত্রের যে অপূর্ব রূপায়ণ ,তাকে একমাত্র চিরজীবন্ত করে আপন বক্ষে ধরে রাখে গ্রন্থাগার। সে সব রকম জ্ঞান- সাধনার শ্রেষ্ঠ সহায়ক। সুখ- দুঃখে,উত্থান-পতনে, সম্পদে- বিপদে সব অবস্থায় সব কালের সকল মানুষের পরম বন্ধু সে। সে অজানাকে জানায়, অপরিচিত কে পরিচিত করে, উন্মোচিত করে জ্ঞান রাজ্যের নব নব দিগন্ত পট। তার সীমাহীন জ্ঞান ভান্ডার থেকে জ্ঞানী পায় জ্ঞানের খোরাক, ভাবুক পায় ভাব রাজ্যের সন্ধান, জ্ঞান তপস্বী অর্জন করে দুশ্চর তপস্যায় সিদ্ধিলাভের উপযোগী সম্পদ।
গ্রন্থাগারের ইতিবৃত্ত:
গ্রীক ও সিন্ধু সভ্যতার মতো ব্যবিলনীয় সভ্যতা সুপ্রাচীন। ব্যবিলনীয় সভ্যতায় মানুষ যে গ্রন্থাগার গড়তে শেখে,তার ঐতিহাসিক নজির আছে। তখনো কাগজ ও মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কৃত হয়নি, লেখা হতো পাথরের ফলকে কিংবা পোড়ামাটির উপর। তারপরেও বহুযুগ ধরে লেখা হতো তাম্রপত্র, ভূর্জপত্র, তালপত্র, তুলট কাগজ, কাগজের মতো পাতলা চামড়া। নালন্দা, তক্ষশীলা,আসিরিয়া, আলেকজান্দ্রিয়া প্রভৃতি যেসব জায়গায় প্রাচীন গ্রন্থাগারের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। তা থেকে জানা যায় ওই সব গ্রন্থাগারে রক্ষিত গ্রন্থ রাজি ছিল ভূর্জপত্র, তালপত্র ,তুলট কাগজ প্রভৃতির উপর লিখিত পান্ডুলিপি।
গ্রন্থাগার ও গ্রামের জনশিক্ষা:
গ্রন্থাগার জনশিক্ষার একটি গ্রামে অল্প শিক্ষিত বা অর্ধ শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বেশি। তাদের অনেকের আছে জ্ঞানার্জন স্পৃহা। দেশ-বিদেশের ইতিহাস,ভূগোল, কাব্যকলা জানতে চায়, কিন্তু পরিতাপের বিষয়, প্রয়োজনীয় গ্রন্থাদি পায়না। স্বাধীনতা লাভের পর দীর্ঘদিন অতিক্রান্ত হতে চলেছে, গ্রামে গ্রামে দূরের কথা এক একটি ব্লক পর্যায়েও তেমন উল্লেখযোগ্য কোন গ্রন্থাগার নেই। অথচ গ্রন্থ ছাড়া শিক্ষা ও জ্ঞান বিস্তারে পথ কিভাবে সুগম হতে পারে ? গ্রামে বয়স্ক শিক্ষার কথা বলা হয়ে থাকে, বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র কোথাও কোথাও গড়ে উঠেছে, কিন্তু এসব শিক্ষিত মানুষের হাতে প্রয়োজনীয় পত্রপত্রিকা গ্রন্থাদি দিতে না পারলে এ পরিকল্পনা কখনোই সার্থক ও ফলপ্রসূ হতে পারে না। পত্রপত্রিকা, গ্রন্থাদির মূল্য ক্রমবর্ধমান, গরিব কেন মধ্যবিত্ত মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। এ পরিস্থিতিতে গ্রন্থাগারই মানুষের জ্ঞানার্জন -বাসনাকে অক্ষুন্ন রাখতে পারে। এজন্য গ্রামীণ জীবনে গ্রন্থাগার প্রয়োজন।
গ্রন্থাগারিকের দায়িত্ব:
পাঠকের অধ্যায়ন স্পৃহা ও জ্ঞান পিপাসা কে সার্থক করার দায়-দায়িত্ব গ্রন্থাগারিকের উপর ন্যস্ত। সাধারণ হালকা চটুল গল্প উপন্যাসের পাঠক সংখ্যাই বেশি। পরিশ্রম করে দুরূহ জ্ঞানচর্চা করতে সাধারণ পাঠক অনাগ্রহী। গল্প উপন্যাসের সঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞানের গ্রন্থ যাতে পাঠক সাধারণ অধ্যায়ন করে সেদিকে নজর দেবেন গ্রন্থাগারিক।
গ্রন্থ ব্যবহারের শিক্ষা :
গ্রন্থাগারের গ্রন্থ ব্যবহারের শিক্ষা ও আমাদের গ্রহণীয় ।স্মরণ রাখতে হবে— গ্রন্থাগার সর্বসাধারণের। গ্রন্থ যাতে যুগ যুগ ধরে অসংখ্য পাঠক ব্যবহার করতে পারে, সেদিকে যত্নবান হতে হবে পাঠক কে। গ্রন্থ অপহরণ ,গ্রন্থের পৃষ্ঠা কর্তন, গ্রন্থের উপর মন্তব্য লিখন প্রভৃতি হীন মনোবৃত্তি ও বদঅভ্যাসগুলো পরিত্যাগ করতে হবে।
উপসংহার:
শিক্ষা- সভ্যতা-সংস্কৃতির সমৃদ্ধি সাধনে গ্রন্থাগারের অবদান অতুলনীয়। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় জনশিক্ষা প্রয়োজন, গ্রন্থাগার তা পূর্ণ করতে পারে। সে জন্য নগর- নগরী থেকে সুদূর গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত প্রতিটি জনপদের গ্রন্থাকারে প্রতিষ্ঠিত অপরিহার্য। গ্রন্থাগারের ব্যাপক প্রসার অশিক্ষা ও অজ্ঞতার নাগপাশ থেকে মুক্তির পথ ঘটতে পারে।