সাহিত্যকে সমাজের দর্পণ এই বলা হোক কিংবা মননের উৎসই বলা হোক একথা অনস্বীকার্য যে সাহিত্যের জন্ম মানুষের মনে। তাই সাহিত্যকে পরখ করা উচিত মনের অন্তর থেকে। প্রথমে ধরা যাক সাহিত্য কি? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে চেয়েছেন বহু জ্ঞানীগুণী মানুষ কিন্তু সঠিক সংজ্ঞা দিতে সবাই ব্যর্থ। তাই সে বিষয়ে আমার চেষ্টার দৃষ্টান্ত নিন্দনীয় অপরাধ। দ্বিতীয়তঃ সাহিত্যের জন্ম কোথায়? ‘ জীবনস্মৃতিতে ‘ কবিগুরু বলেছেন স্মৃতির সে ছবি মনে ফুটে ওঠে , তার শব্দ রূপায়ণ অর্থাৎ তাকে শব্দে ফুটিয়ে তোলায় সাহিত্য । কথাটি নির্ভেজাল সত্য। কারণ কবির মতে সে আজান চিত্রকর মনের পটভূমিতে বাস্তবকে আবার নতুন করে ঢেলে আঁকে। সেই আকার মূল্যই সাহিত্য, বাহ্যিক দুনিয়ায় সেই চিত্র করই সাহিত্যিক। অতএব উপরোক্ত বিষয় থেকে এই উপসংহারে আসা যায় যে মনের অন্তর থেকে ফোনিভ চেতনা স্রোতের সুবাসের বাহ্যিক দুনিয়ায় শব্দরূপে আগমনী এক কথায় সাহিত্যের মূল উৎস। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে সাহিত্য পড়ব কেন? এ বিষয়ে স্মরণ নেওয়া উচিত কবিগুরুর। তিনি বলেছেন—-
“আলো সবে ভালোবেসে
মালা দেয় আঁধারের জলে,
সৃষ্টি তারে বলে।”
অর্থাৎ ভালো-মন্দ, দুঃখ ও সুখ, পতন ও উত্থান ইত্যাদি নানা বিপরীত মুখী বিষয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত মানুষের জীবন যাত্রায় অভেদ্য আসন সাজিয়ে রেখেছে। এদের নিত্যনৈমিত্তিক সংঘাত এই মানব জীবনের সার টি লুকিয়ে আছে। এবং তাই মানব চিন্তা ধারা এতই ‘Dynamic’ বা ‘দ্রুত পরিবর্তনশীল’। আর এই পরিবর্তনের হাওয়াই সাহিত্যে ধরা পড়ে। এ সাহিত্য অবশ্য ‘মানবকেন্দ্রিক’ বা ‘মানবতাবাদ’ সাহিত্য তবে প্রকৃত সাহিত্যের সাথে এ অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত হয়তোবা প্রকৃত সাহিত্যই।
তাই এ মানবতাবাদ সাহিত্য থেকে আমরা মানুষের জয় গান খুঁজে পাই, বহু যুদ্ধের পর ব্যক্তিবিশেষের জীবনের চরিতার্থতা খুঁজে পাই, সমাজকে গোষ্ঠী হিসেবে না দেখে ব্যক্তিবিশেষের মধ্যে দিয়ে দেখি। তাই তাদের দর্পণে নিজেদের ফুটিয়ে তুলি এবং নিজেদের অস্তিত্বের এবং সভ্যতার সার্থকতা খুঁজে পাই।
তবে আমরা আমাদের সাহিত্য অনুরাগ কে মানবতাবাদের কচকচানি থেকে মুক্ত করে গগনে গরজে মেঘের গর্জন শোনার চেষ্টা করি। প্রকৃতি বিষয়ক সাহিত্যের দরজাটা আবার অনেক খোলা। এখানে নেই কোন বিশ্লেষণের চাপ। কেবলই আছে হরির লুটের মতন শুধু কুড়িয়ে নেওয়া পালা। প্রকৃতির সাহিত্য আমাদের আনন্দ দেয়। মনকে ক্ষুদ্র সংস্কার থেকে মুক্ত করে বৃহৎ এর দিকে নিয়ে যায়। যা কিছু ‘সত্য শিব সুন্দর।’ সব তারই খোঁজে প্রাণ ছোটে। প্রকৃতি সাহিত্যের প্রগাঢ় প্রভাব ‘বসুধা’- কে ‘খন্ড ক্ষুদ্র’ না করে ‘বৃহৎ’- এর ত্রানে ছুটিয়ে নিয়ে যায়। আপন ভূমির উপর না রেখে মানুষ ডানা মেলে আকাশে। সাহিত্যের প্রভাব মানুষের মনের ‘খাঁচার পাখি কে’ বনে উড়িয়ে দেবে এই আশা করা যায়। তবে সুবিশাল সাহিত্য প্রাঙ্গণ কে দুটি বিষয়ে বেঁধে দিলে তা প্রায় ক্ষমাহীন অপরাধ হবে। তাই ‘প্রেম সাহিত্য’ সেখানে কবি বলেন—
“প্রাণের বাঁধন বেঁধেছি প্রাণেতে দেখি কে খুলিতে পারে।”
তারপর ভক্তি সাহিত্য– যেখানে কবি বলেন-
“ওগো বিশ্ব ভূপিতা , দেহে মনে প্রাণে আমি একি অপরূপ”।
আর তাই কবির এই চেতনা পঠন করলে আমরা ও প্রেমী বা ভক্ত হয়ে পড়ি। কবির সাহিত্য আমাদেরও মনের অনেক ‘বন্ধ চোখের আগল’ ঠেলে রংয়ের ঝিলিক ঝলমলে দেখিয়ে দেয়। তবে ক্রমশই আমরা সাহিত্যের বিশাল বিস্তার ও তার পঠনের উপকারিতা এই দুই প্রশ্নের একটি উত্তরের দিকে ক্রমশই এগিয়ে যাচ্ছি। সাহিত্য সে যে সাহিত্যিক হোক মানবতাবাদি যা প্রকৃতি কেন্দ্রিক বা ভক্তি সুলভ বা রোমান্টিক সবার কাছেই এ একই ভাব বহন করে। সাহিত্যের এই সঙ্গে স্থাপনে লালন করা আশ্চর্য প্রদীপ হলো ‘চিন্তা ভঙ্গি’, এবং দৃষ্টিভঙ্গি। এই জগত কে আমরা যেভাবে দেখব, পৃথিবী আমার কাছে সেরকম হবে। একটি মৃতদেহ শকুনের কাছে নিয়ে আসে খাবারের নিশ্চিততা। সহৃদয় ব্যক্তির কাছে নিয়ে আসে শোক, পরিবারের বুকে নিয়ে আসে স্তব্ধতা, হত্যাকারীর কাছে নিয়ে আসে উল্লাস। তাই জগৎকে আমরা সেভাবে দেখব জগত ঠিক সেরকমই। কবিগুরু এ প্রসঙ্গে বলেছেন –
“আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ ,
চুনি উঠল রাঙা হয়ে ।
আমি চোখ মেললুম আকাশে- জ্বলে উঠলো আলো,
পুবে-পশ্চিমে।
গোলাপের দিকে তাকিয়ে বললুম সুন্দর ,
সুন্দর হল সে।”
তাই আমাদের কাছে সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা হল পূর্বে বড় বড় বিদ্বান মনীষী লেখকদের কথা আমাদের মনের শ্রেষ্ঠ দরজাটি কে খুলে দেবে, পান্নাকে সবুজ, গোলাপকে সুন্দর বলবে, শান্ত বা দিকভ্রান্ত সহযাত্রী কেও আপন করে নিতে শেখাবে চেতনার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটাবে । তাই আমরা যখন আমাদের স্বল্প পরিসরের জীবনে পৃথিবীর সেরা টুকু নিতে চাই তখন না হয় “প্রেমের অতিথি কবি চিরদিন আমারই অতিথি” হোক, তাই সাহিত্য আমাদের সুস্থ জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।