‘মাতৃভাষা বাংলা বলিয়াই কি বাঙালিকে দণ্ড দিতে হইবে? যে বেচারা বাংলা বলে সেই কি আধুনিক মনুসংহিতার শূদ্র? তার কানে উচ্চশিক্ষার মন্ত্র চলিবে না ?’
– রবীন্দ্রনাথ
ভূমিকা
মাতৃভাষার মাধ্যমে জাতিকে মুক্ত নেই। এতোকাল আমরা বিদেশী ভাষার দাসত্ব গ্রহণ করেছি। দেশের মুষ্টিমেয় শিক্ষিত মানুষ ইংরেজি ভাষায় প্রবন্ধ লিখেছেন, জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিচ্ছেন, বিতর্কমূলক আইনের খসড়া প্রস্তুত করছেন এবং দেশময় হৈ-চৈ শুরু করছেন। ইংরেজি ভাষার সেই দুর্বোধ্য সাইক্লোনে দেশের অগণিত অশিক্ষিত জনসাধারণ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। সেই মুক্তিযোগ্য জনসাধারণের আমন্তণ ছিল না। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশাল মানবগোষ্ঠীকে ইংরেজি ভাষার কৃত্রিম গণ্ডির বাইরে নির্বাসিত রেখে তারা শিক্ষা-দীক্ষার জ্ঞান বিজ্ঞানে রাজনীতিতে রাজনীতিতে একটি বিজাতীয় নতুন সংস্কৃতি গড়ে তোলার অপচেষ্টা করেছিল। দেশের মাটি সঙ্গে, দেশের মানুষের সঙ্গে, দেশের জল-হাওয়ার সঙ্গে তার কোনো নিবিড় যোগ- বন্ধন ছিল না।
ইংরেজি ভাষার প্রয়োজনীয়তা
কিন্তু একদিন আমাদের জাতীয় জীবনে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষার প্রয়োজন ছিল। প্রাচীন যুগের সেই অজ্ঞতার অন্ধকার অপসারণ ও মূঢ়তা- মুক্তির জন্য আমাদের প্রাচ্য কূপমন্ডুকতার সঙ্গে পাশ্চাত্য চিত্র- সংঘাতের প্রয়োজন ছিল। বিশাল বিশ্ব থেকে নির্বাচিত হয়ে আমরা যে নানা অন্ধকার কুসংস্কারের অন্ধকূপে নিমজ্জিত হয়েছিলাম, আমাদের মনের সেই জড়তাগ্রস্ত, স্থবির অচনায়তনকে বিধ্বস্ত করল যুরোপীয় মনের জঙ্গম শক্তি। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের হাত ধরেই আমরা প্রাচীন রক্ষণশীলতার আধুনিক যুগের আলোকিত প্রাঙ্গণে পদার্পন করেছি। পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং ইংরেজি ভাষা সে দিক থেকে ছিল আমাদের মুক্তিদূত।
ইংরেজি ভাষা-সর্বস্বতার পরিমাণ
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে আমাদের চিন্তামুক্ত ঘটলেও এদেশে ইংরেজি ভাষা প্রবর্তনের মূলে ছিল ভারতের মনোবিজয়ের চক্রান্ত। সেই চক্রান্ত সফল হয় আর তার ফলে এ দেশে যে নবজাগরণ এলো, তা আমাদের অতিরিক্ত লাভ। কিন্তু তাই বলে বিদেশি ভাষার সর্বসমতার কোন জাতির পক্ষে গৌরবজনক নয়। ইংরেজি ভাষার মধ্যস্থতায় আমরা সুদূর বিশ্বকে জেনেছি; কিন্তু আমরা ঘরের মানুষকে, তার সুখ দুঃখ কে জানতে পারেনি।
জাতীয় অপচয়
তাই স্কুল-কলেজে ইংরেজি ভাষার অবগুন্ঠতি বিদ্যা স্বভাবতই আমাদের মনের সহবর্তিনী তিনি হতে পারেনি। সেজন্য আমরা যে পরিমাণ শিক্ষা পাই ,সে পরিমাণে বিদ্যা পাইনা। আমাদের শিক্ষার ভোজে ঘটে অপরিমেয় অপচয়। সেই অপচয় শক্তি ও সম্পদের অপচয়, এককথায় জাতীয় অপচয়। রবীন্দ্রনাথ তাই সখেদে বলেছিলেন, ‘আমাদের ঘর আসবি স্কুলের মধ্যে ট্রাম চলে, মন চলে না।’
মাতৃভাষার অভিষেক
পরাধীনতার অবসানে নিজের ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখা গেল, সেখানে ,অশিক্ষা ও দারিদ্র্যের অন্ধকার হয়ে আছে। তা দূর করা ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে সম্ভব নয়। সেখানে আহ্বান করতে হবে মাতৃভাষাকে। সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড়ের ভাষা দিয়ে আর যা-ই হোক, কোন জাতির মাতৃ- পূজার বোধন- মন্ত্র কখনোই রচিত হতে পারে না।
শিক্ষা ও জীবনে মাতৃভাষা
আমরা যেভাবে জীবন নির্বাহ করিব আমাদের শিক্ষা তাহার আনুপাতিক নহে, যে গৃহে আমৃত্যুকাল বাস করিব, বসে গৃহের উন্নত চিত্র আমাদের পাঠ্যপুস্তকে নাই, যে সমাজের মধ্যে আমাদিগকে জন্ম যাপন করিতে হইবে. সে সমাজের কোন উচ্চ আদর্শ আমাদের নতুন শিক্ষিত সাহিত্যের মধ্যে লাভ করি না, আমাদের পিতা-মাতা আমাদের- সহিত বন্ধু- আমাদের মাতৃভূমিকে তাদের মধ্যে প্রত্যক্ষ দেখি না, আমাদের আকাশ এবং পৃথিবী, আমাদের নির্মল প্রভাত এবং সুন্দর সন্ধ্যা আমাদের পরিপূর্ণ শস্যক্ষেত্র এবং দেশলক্ষী স্রোতস্বিনী কোন সংগীতে তাহার মধ্যে ধ্বনিত হয় না, তখন বুঝিতে পারি আমাদের শিক্ষার সহিত আমাদের জীবনে তেমন নিবিড় মিলন হইবার কোন স্বাভাবিক সম্ভাবনা নাই। কিন্তু এ মিলনকে সাধন করিতে পারে? বাংলা ভাষা ,বাংলা সাহিত্য।’ মাতৃভাষায় সর্বদেশে সর্বকালে চিত্র মুক্তির বাহন হয়েছে। এ বাংলাদেশেও তাই হবে।
চিত্ত মুক্তি ও মাতৃভাষার সমৃদ্ধি
যে ভাষায় শিশুর মুখে বলি ফুটে, সে ভাষা তার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস হৃদস্পন্দনের সঙ্গে তার সঙ্গে মিশে থাকে। সেই ভাষাতেই তার চিত্ত- মুক্তি সম্ভব। যে ভাষায় মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র প্রমুখ সাহিত্যকেরা তাদের প্রতিভার নৈবেদ্য রচনা করে গিয়েছেন, তা ব্যর্থ হতে পারে না।
মাতৃভাষার মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলা মাধ্যম
পূর্ব- বাংলায় [বর্তমান বাংলাদেশ] কেবলমাত্র উর্দুকে তার একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা হয়, যখন চক্রান্ত করা হয় তখন বুকের রক্তের মূল্যে তারা রক্ষা করে মাতৃভাষার পবিত্র অধিকার। কিন্তু সন্তান-সন্ততির নামকরণের ক্ষেত্রে বিদেশি আনা কেন ?অবশ্য রবীন্দ্রনাথ, স্যার আশুতোষ ,প্রমুখ মনীষীগণের চেষ্টায় বহুদিন হল উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার মাধ্যমে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
উপসংহার
মাতৃভাষার মাধ্যমে আমাদের জাতীয় শিক্ষা ও জাতীয় জীবনের মধ্যে এবার নিবিড় যোগসূত্র স্থাপিত হোক। এইবার ‘মাতৃভাষার অপবাদ দূর হোক, যোগশিক্ষার উদ্বেল ধারা শুষ্ক নদীর রিক্ত পথে বয়ে যাক, দুই কূল জাগুক পুন্য চেতনায় , ঘাটে ঘাটে উঠুক আনন্দ- ধ্বনি’