বাংলার একটি গ্রামের চিত্র/ আমার প্রিয় গ্রাম (My Village)

ওই গাঁ-ই আমার 'জন্মভূমি স্বর্গপুরী'। ওর আলোতে আমি প্রথম চোখ মেলেছি ।বুক ভরে নিয়েছি ওর তাজা প্রাণদ বাতাস। ওর মাঠের শস্যকণা, বাগিচার ফলমূল দিয়েছে ক্ষুধার অন্ন, দিয়েছে দেহের পুষ্টি।

” ওই যে গাঁটি যাচ্ছে দেখা আইরি ক্ষেতের আড়ে”——–

ভূমিকা:

ওই গাঁ-ই আমার ‘জন্মভূমি স্বর্গপুরী’। ওর আলোতে আমি প্রথম চোখ মেলেছি ।বুক ভরে নিয়েছি ওর তাজা প্রাণদ বাতাস। ওর মাঠের শস্যকণা, বাগিচার ফলমূল দিয়েছে ক্ষুধার অন্ন, দিয়েছে দেহের পুষ্টি। ওর নদনদী , মাঠঘাট, গাছগাছালি, পাখপাখালি ও মানুষজনের সঙ্গে ক্রমপরিচিতির নৈকট্যে ঘটেছে আমাদের হৃদয়ের যোগ, আত্মার আত্মীয়তা। তাই আমার গর্ব

‘ঐটি আমার গ্রাম ,আমার স্বর্গপুরী, ঐখানেতে হৃদয় আমার গেছে চুরি’।

প্রকৃতির রূপ বিস্তার:

ছায়া সুশীতল শান্ত পরিবেশে আমার গ্রামটি অবস্থিত। গ্রামের উত্তর প্রান্ত ছুয়ে সোজা প্রবাহিত হয়েছে স্বচ্ছ সলিলা বিদ্যাধরী। নদী কিনারা ছাড়িয়ে দক্ষিণমুখে এলেই দিগন্তবিস্তৃত অবারিত মাঠ। মাঠের পূর্ব-পশ্চিম লাগোয়া বাড়িঘরে জটলা। টালি খড়ের ছাওয়া মাটির ঘর, দু’চারটে পাকা দালান কোঠা ও আছে। এ পাড়ায় ও পাড়ায় যাওয়া আসার যোগসুত্র গাঁয়ের পায়ে হাঁটা পথ। পথের দুধারে কোথাও বাঁশের ঝাড়, কোথাও ঘেঁটু আশশেওড়ার জঙ্গল, কোথাও হিজল অর্জুন করঞ্জার শাখা প্রশাখায় গুলঞ্চ লতার বিস্তার কোথাও ঝুরি নামিয়ে গ্রাম ইতিহাসের নীরব সাক্ষী প্রাচীন বট। তাল খেজুর পাকুড় অশ্বত্থ আছে এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। গায়ের পূবের দিকে আম-কাঁঠালের বাগান রাখালের খেলাগৃহ।

পশ্চিমে ঘরামি পাড়াকে ডাইনে রেখে নয়ানজুলির ছোট বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে কয়েক পা এগোলেই মজে যাওয়া পদ্ম দীঘি। তাহলেও দু’চারটে পদ্ম ফুটে এখনো। সূর্যোদয় সূর্যাস্তের বর্ণালি শোভা দেয় নয়ন মন জুড়িয়ে। জোৎস্নার দুধ সাগরে ডুব দিয়ে ওঠা নৈশ প্রকৃতির রূপ মাধুর্যের তুলনা হয় না। পশুপাখির বিচিত্র কলতানে ভরে থাকে গাঁয়ের প্রকৃতি অঙ্গন। গাভী ডাকে হাম্বা বলে। ফুলের কানে কানে গুনগুনিয়ে কথা বলে অলি। কোকিল ডাকে মধুস্রাবী পঞ্চমে। ডাকে কুবো কুব কুব লুকায়ে কোথায়। বউ কথা কও এর ডাক চাতকের কাতর ধ্বনি ঘুঘুর ক্লান্ত স্বর গ্রাম্য প্রকৃতির বিশিষ্ট্য ধ্বনি-সম্পদ।

ঋতুতে ঋতুতে রূপসজ্জা:

আমার প্রিয় গ্রামটি ঋতুতে ঋতুতে সাজে নবরূপে। গ্রীষ্মের দাবদাহে খাল ডোবা নালা যায় শুকিয়ে। বিদ্যাধরী অতলে নেমে যেন দুপায়ে বালির বাধা ঠেলে এগোয়। শত দীর্ণ মাঠ থেকে শস্য শুন্য। বর্ষা আকাশে সজল কালো মেঘের মেলা। কখনো মাঝে মাঝে কখনো দিনভর বৃষ্টি ঝরে অবিরাম। খাল ডোবা নালা জলে ভরে থৈথৈ। মাঠে চলে চাষের কাজ। ধান পাঠ আখের চারাগুলি সবুজ ও সতেজ হয়ে মাথা জাগিয়ে ওঠে। যেদিকেই চোখ ফেরানো যায় অপূর্ব শ্যামশোভা। ভাদ্রে অরুণ আলোর অঞ্জলি নিয়ে আসে শরৎ। শিশির ভেজা দুর্বায় ঝরে শিউলি , কাশফোটে। নির্মেঘ আকাশের রুপোহাস হাসি হাসে চাঁদ। হেমন্তের শিশির আর হিমের পরশে মাঠের মঞ্জরিত শস্যে ধরে সোনা রং। শীতে পাকা ফসল ঘরে তোলার কাজে ব্যস্ত হয় গাঁয়ের মানুষ। রবি শস্য চাষের কাজ চলে একই সঙ্গে। ফাল্গুনের আলোর সোনার কাঠিতে ঘুমঘোর শীতাতুর প্রকৃতি জেগে ওঠে। ঝরা পাতার পালা চুকে গিয়ে নব কিশলয়ে ভরে ওঠে রিক্ত শাখা প্রশাখা।

পূজো পার্বণ ও সাংস্কৃতিক জীবন:

গ্রামের মানুষ আজ ও বারো মাসে তেরো পার্বণের আনন্দে মাতে। দশহারা, মনসার পূজো, ভাদু লক্ষ্মীপুজো, কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো, নবান্ন, পৌষ পার্বণ, শিবের গাজন, শীতলা -চন্ডী ধর্ম ঠাকুরের পুজো এমন কত অনুষ্ঠানই হয় সারা বছর। তাছাড়া শারদীয়া পূজোর মতো সর্বজনীন উৎসবে ও মাতে গ্রামের মানুষ। গ্রামীণ সাংস্কৃতিক জীবন ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। নাম সংকীর্তন এর আসর বসে হরির লুঠ হয়, মহোৎসবে সব শ্রেণীর মানুষ পঙক্তিভোজে প্রসাদ গ্রহণ করে, রায়েদের হরিতলায় আজও কথকতার আসর বসে, সুরেশ ওঝার মনসার থানে মনসার ভাসান গান হয়। গাজন উপলক্ষে মিনি সিনেমা বসে সারারাত ধরে চলে ভিডিও প্রদর্শনী। বৈষ্ণবের আখড়ার প্রভাতী সংগীত কিংবা মসজিদের আজান সকালে ঘুম ভাঙার।

দুঃখ দারিদ্রের দিক:

তা বলে কি গাঁয়ের মানুষের দুঃখ কষ্ট দারিদ্র্য নেই? সবই আছে। দীর্ঘদিনের অবহেলা আর বঞ্চনা আর পাঁচটা গ্রামের মতোই এ গাঁয়েও হতশ্রী অবস্থা। অনেক খাল ডোবাই কচুরিপানায় ভরা ,পথঘাট এর আশপাশ জঙ্গলাকীর্ণ। দারিদ্র কৃষিজীবী ও খেটে খাওয়া মানুষের নিত্যসঙ্গী। প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যকেন্দ্র পথঘাট যানবাহনের একান্ত অভাব।

উপসংহার:

তবুও গ্রাম আমার স্বর্গপুরী। গ্রামের মানুষ আবাদ করে, বিবাদ করে, আবার সুবাদও করে। তারা সরল নিরভিমান। তারা বাধা বাঁধন হারা তারা স্বাধীন সুখী। এখানে আছে মায়ের বুকভরা স্নেহ বাপের সস্নেহ শাসন, প্রিয়জনদের অকৃত্রিম ভালোবাসা। বিপদে এপাড়ার ও পাড়ার মানুষ আসে বিবাদ-বিসম্বাদ ভুলে। আনন্দ উৎসবের কল্যাণী ইচ্ছা ও সকলে ভাগ করে নেয় সহর্ষ চিত্রে। সেজন্যেই তো গ্রাম আমার এত প্রিয়– ‘মনটি আমার সেথায় গেছে চুরি’।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts
Scroll to Top