ভূমিকা
মেলা’ কথাটির অর্থ বহু মানুষের মিলনস্থল। কিন্তু ব্যবহারে মেলা কথাটির অর্থ সুনির্দিষ্ট।অর্থাৎ বহু মানুষ একত্রে মিলিত হলেও বহু মানুষের যেকোন মিলন স্থলকেই মেলা বলা যায় না। কোন ও একটি উপলক্ষে যেখানে হরেক রকমের জিনিসপত্র অস্থায়ী দোকানপাট বসে, বেচাকেনা চলে, আমোদ-প্রমোদের আয়োজন থাকে তাকেই মেলা বলে।মেলার উপলক্ষ প্রধানত ঠাকুর দেবতার পূজা বা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অতিথি যেমন ঝুলন, শিবরাত্রি, রাসযাত্রা, পৌষ সংক্রান্তি, চৈত্র সংক্রান্তি ইত্যাদি। এছাড়া সাধু-সন্ন্যাসী, মহাপুরুষের আবির্ভাব বা কোন আশ্রম মঠের প্রাতিষ্ঠানিক দিবস উপলক্ষে মেলা বসে। বাংলাদেশের অসংখ্য মেলার মধ্যে কলকাতার মাহেশের রথের মেলা, জয়দেব কেঁদুলির মেলা সাগর মেলা, কোচবিহারের রাসমেলা, শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা প্রভৃতি বিখ্যাত। এদের মধ্যে সাগরদ্বীপে কপিল মুনির আশ্রমের সাগর মেলা সর্বভারতীয় গুরুত্ব অর্জন করেছে। মেলা এক দিনেও হয় আবার কোন কোন মেলা তিন চারদিন থেকে পনের দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
মেলার বিবরণ
সাধারণত রথতলা,খোলা মাঠ, নদীর তীর বা মন্দির সংলগ্ন কোন উন্মুক্ত স্থানে মেলা বসে। মেলার স্থায়িত্ব ও গুরুত্ব অনুযায়ী মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। কোন কোন মেলায় ভিড় উপচে পড়ে। বহু লোকের সমাগম হয়। মেলার ভিড় নিয়ন্ত্রণ, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, পানীয় জলের ব্যবস্থা ইত্যাদির জন্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী নিয়োগ ,প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন, শান্তিরক্ষার জন্য অস্থায়ী পুলিশ শিবির পর্যন্ত স্থাপন করতে হয়। নির্দিষ্ট দিনের কয়েকদিন আগে থেকে দোকানিরা যে যার জায়গা নিয়ে অস্থায়ী জ্বালা চালা বাঁধে। মেলার দিন যত এগিয়ে আসে নানা দিক থেকে দুটো একটা করে দোকানী এসে তাদের পসরা সাজায়। দেখতে দেখতে মেলা প্রাঙ্গনটি দোকানে দোকানে ভরে যায়। দেশ-বিদেশের হরেক রকম কত বিচিত্র পসরার সমাবেশ হয় মেলায়।
এক একটি মেলা কোন ও বিশেষ জিনিসের জন্য খ্যাত। তবে সব মেলাতেই জামাকাপড়, শাড়ি, রঙিন বেলোয়ারী চুড়ি, খেলনা, পুতুল, মাটির জিনিস, কাঠের জিনিস, চামড়ার জিনিস, নিত্যব্যবহার্য নানা জিনিস যেমন হাতা, খুন্তি, চাটু,বেড়ি, ঝুড়ি,কুলো প্রভৃতির সারি সারি দোকান থাকে। একদিকে থাকে ফুল ফল, শাকসবজির বীজ, গাছের দোকান আর একদিকে পাখির মেলা চন্দনা, টিয়া, ময়না, কাকাতুয়া কত রকমের রংবেরঙের পাখি। মেলার এক প্রান্তে থাকে আমোদ-প্রমোদ ও আনন্দের আয়োজন ও উপকরণ সার্কাস, ম্যাজিক, নাগরদোলা আর সমস্ত মেলা প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে থাকে চা ও খাবারের দোকান। দলে দলে লোক আসে মেলায়। কেউ ঘুরে ঘুরে মনের মত জিনিস কেনে, কেউ আত্মীয় বন্ধুর সঙ্গে গল্প করে, কেউবা শুধুই মেলা দেখে। বিকালের দিকে মেলায় ভিড় বাড়তে থাকে। আর সন্ধ্যার পর যখন দোকানে দোকানে উজ্জ্বল আলো জ্বলে ওঠে তখন মেলা প্রাঙ্গণ টি ঝলমল করে। ছোট ছেলে মেয়েদের সহর্ষ কলরবে, তরুন তরুনীর আনন্দ-উচ্ছ্বাসে ক্রেতা বিক্রেতাদের দরকষাকষিতে, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনের চিৎকার-চেঁচামেচিতে মেলা প্রাঙ্গন গমগম করতে থাকে। ধীরে ধীরে রাত গভীর হয়, মেলা প্রাঙ্গণ ও জনবিরল হয়ে আসে।
সমাজ জীবনে মেলার প্রয়োজনীয়তা
‘মেলা’ মানে মিলন ক্ষেত্র। সকল সমাজবদ্ধ মানুষের মিলন এর উৎস স্থল হিসাবে মেলার প্রয়োজনীয়তা সমাজ জীবনের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শহুরে সমাজ বাসী মানুষের কাছে তেমন আকর্ষণীয় নয়। কারণ মেলার সঙ্গে তাদের হৃদয়ের কোন সংযোগ থাকে না। শহরের মেলায় তাই শহুরে কৃত্রিমতা লক্ষণীয়। নেহাত প্রয়োজন হলে তবেই শহরের মানুষ মেলায় আসে। কিছু কাজ নেই,সময় কাটছে না, চলো মেলা দেখে আসি। এই ভাব নিয়ে মেলায় যায়। আবার গ্রামীণ সামাজিক মেলার প্রতি শহরবাসী মানুষের বহু আকাঙ্খিত ও দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বস্তু। আর গ্রাম্য সামাজিক মানুষের কাছে এক বিরাট উৎসব। অসংখ্য মানুষের হৃদয়ের উত্তাপ দিয়ে এক একটি গ্রামের মেলা গড়ে ওঠে। মেলার সঙ্গে সমাজের থাকে নিবির সংযোগ। সামাজিক জীবনে তাই মেলার গুরুত্ব অপরিসীম।মেলা সমাজবদ্ধ মানুষকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। সমাজ জীবনে মেলার সবচেয়ে বড় অবদান আনন্দ দান। বর্তমান সমাজ জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ এই যে, নির্মল সংস্কৃতির মুলক আনন্দলাভের উপলক্ষ বা উপকরণের বড়ই অভাব। সারাদিন নানা কাজে ব্যস্ত থাকে মানুষ, তারপর ক্লান্ত-অবসন্ন শরীরে নিষ্ক্রিয়তায় ও নিরানন্দে নিদ্রাদেবীর শরণাপন্ন হয়। মেলায় গিয়ে সমাজ জীবনে বৈচিত্রের সঞ্চার করে। নিরানন্দ গদে বাঁধা জীবনকে আবেগে আপ্লুত করে। আনন্দের জোয়ারে মথিত এবং আলোড়িত করে। সমাজ জীবনে তাই মেলার গুরুত্ব অপরিসীম।
গ্রাম্য মেলা শহুরে মেলা
শহরবাসী মানুষের কাছে সার্বজনীন দুর্গোৎসব যেমন প্রধান উৎসব,গ্রামবাসী মানুষের কাছে মেলা তেমনি আনন্দের, তার চেয়ে আরো আন্তরিক। একটি মেলাকে কেন্দ্র করে আশেপাশের বিশ পঁচিশ টি গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা উৎসাহ-উদ্দীপনায় চঞ্চল হয়ে ওঠে।এক বছর পর তাদের কাছে মুক্ত জীবনের স্বাদ এনে দেয়। শহর জীবনে এই চিত্রটি অনুপস্থিত। শহরবাসী মানুষের জীবন বিভিন্ন পেশা এবং কার্য সূত্রে বাধা পড়ায় আনন্দ অবকাশ থাকে না। গ্রামের সংকীর্ণ গন্ডির ওপারে যে বিপুল ও বিচিত্র জগত রয়েছে মেলা গ্রামবাসীদের কাছে সেই জগতের সন্ধান বয়ে আনে। কবে মেলা আরম্ভ হবে সেই প্রতীক্ষায় তারা দিন গুনতে থাকে। শহরবাসী মানুষের কাছে সেই প্রতীক্ষার সময় অনুপস্থিত। তারা যান্ত্রিক সভ্যতার আধুনিকতার উপকরণগুলি নিয়েই সদা ব্যস্ত।
উপসংহার
মেলার অর্থ মিলন। মেলার মাধ্যমে এই মিলন মানুষের কাছে খুবই আনন্দ মধুর। অনেকে শুধু এই মিলনের আনন্দটুকু উপভোগ করার জন্য মেলায় যায়। মেলা প্রাঙ্গণে মিলন ঘটে বহু পরিচিত কিন্তু বহুদিনের আদর্শনীয় মানুষের সঙ্গে। পরস্পরের কুশল বিনিময়, সুখ-দুঃখের গল্পে সেই মিলন নিবিড় এবং হৃদ্যতা পূর্ণ হয়ে ওঠে।মেলা না থাকলে মানুষ আনন্দ লাভের একটি বড় সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতো।