বর্ষায় কলকাতার রাস্তায় একজন নিঃসঙ্গ মানুষ/ জলমগ্ন রাস্তায় একাকী একদিন (One Day Alone on a Submerged Road)

বড় রাস্তায় এসে পড়েছি কখন জানিনা। ঘর্ঘর শব্দে গজরাতে গজরাতে চলে গেল যাত্রী বোঝাই একটা বাস।যেন একখানা স্টিমার, আমাকে নোংরা জলে আবক্ষ গঙ্গাস্নানের পুণ্য দান করে গেল।যতদূর তাকাই, জনপ্রাণী নিই।এমন সময় যে ভয় করছিলাম, তাই হল।টুক করে লোডশেডিং হয়ে গেল। চারদিক অন্ধকার ।

ভূমিকা:

পিসিমার বাড়িতে জরুরী কাজ গুলো সেরে রাত 9 টার আগেই বাড়ি ফিরে আসতে হবে আমাকে। কারণ রাত আটটায় অর্ঘ্যর ট্রেন হাওড়ায় পৌছবে। কাল সকালেই আবার তাকে পাটনায় চলে যেতে হবে। কাজেই নটার আগে আমার বাড়ি ফেরা চাই। তার সঙ্গে আমার কয়েকটা দরকারী কথা আছে। আজ রাতেই ওগুলো সেরে ফেলতে হবে। অর্ঘ্য আমার মাসতুতো ভাই। একটা পারিবারিক কাজে সে পাটনায় যাবে।

যখন বৃষ্টি নামল:

পিসিমার বাড়িতে যখন আমি কাজের মধ্যে ডুবে ছিলাম তখন আকাশ ভেঙে শুরু হয়ে গেল মুষলধারে বৃষ্টি। ভেবেছিলাম বৃষ্টি এক্ষুনি থেমে যাবে। কিন্তু বৃষ্টি থামল না। এ বছরে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে ,সেদিন দু’ঘণ্টার বৃষ্টিপাত ছিল বোধ হয় তার চেয়ে অনেক বেশি। আকাশের বুক উজাড় করে যেন সেদিন হয়েছিল বছরের অধিক বৃষ্টিপাত |

পথ বিজন তিমির সঘন :

বৃষ্টি থামতেই আমি বেরিয়ে পড়লাম। পিসিমা বারণ করেছিলেন আমি তার কথা কানে নিই নি। রাস্তায় নেমেই চক্ষুচড়কগাছ! রাস্তা কোথায়? এ যে নদী! রাস্তা ছাপিয়ে ফুটপাতের উপর জল দাঁড়িয়ে গেছে কম করেও দু তিন ফুট। রাস্তায় লোকজন নেই। একটা রিক্সাওয়ালা নেই। একবার ভাবলাম, এই জলময় রাস্তায় রাত্রিতে একা যাওয়া ঠিক হবে না। আজ রাতে থেকে যাই পিসিমার বাড়ি ।কিন্তু পরমুহুর্তেই মনে পড়ল , আজ অর্ঘ্য আসবে। সকালে তার ট্রেন।

যেতে যেতে একলা পথে:

কাজেই, অভিলম্বে জুতোর পদোন্নতি হলো। পরনের প্যান্ট জলে ভিজলো। ফুটপাতে পা রাখতেই হাঁটু পর্যন্ত ডুবে গেল। এখন বেশ মজা লাগছে। পা দুটো যেন স্বেচ্ছায় স্বাধীনভাবে জল ভেঙে এগিয়ে চলেছে, যাচ্ছে তো যাচ্ছেই ,ঠান্ডা নোংরা জল ভেঙে এগিয়ে চলেছে ।এখন মনে হচ্ছে, পা দুটো বুঝি আমার নয়। যেন অন্য কেউ আমাকে বয়ে নিয়ে চলেছে সেই ঠান্ডা নোংরা জল ভেঙে। লাইটপোষ্টের আলো দিব্যি লুটোপুটি খাচ্ছে রাস্তার ঢেউ তোলা ঘোলা জলে। আলোর কুচি ছড়ানো জলময় রাস্তাটিকে এখন বড় সুন্দর লাগছে আমার। সত্যি, কলকাতা বড় সুন্দর, তার আকাশ সুন্দর ,আকাশের বুকে ভাসমান মেঘ সুন্দর, আর তার আধখানা ভাঙা রূপোলী চাঁদ সুন্দর।

এলেম এ কোন দেশে :

বড় রাস্তায় এসে পড়েছি কখন জানিনা। ঘর্ঘর শব্দে গজরাতে গজরাতে চলে গেল যাত্রী বোঝাই একটা বাস।যেন একখানা স্টিমার, আমাকে নোংরা জলে আবক্ষ গঙ্গাস্নানের পুণ্য দান করে গেল।যতদূর তাকাই, জনপ্রাণী নিই।এমন সময় যে ভয় করছিলাম, তাই হল।টুক করে লোডশেডিং হয়ে গেল।

চারদিক অন্ধকার । অন্ধকারে এখন রাস্তাটাকে আমার সত্যি সত্যিই নদী বলে মনে হচ্ছে। এখন কেমন যেন ভয় ভয় করছে আমার। প্রায় ঘন্টা খানেক হল ,আমি জল ভেঙে হাঁটছি ,একটা মানুষ তো দূরের কথা, কোথাও একটা ইঁদুর -বেড়ালের ও দেখা পাইনি। আমি কি মহেঞ্জোদাড়োর রাস্তায় একা জল ভেঙে হেটে চলেছি ? দু পাশে মাথা উঁচু গোমড়া-মুখো অহংকারী বাড়ির সারি। তার ওপরে ভাঙা এক ফালি চাঁদ ।আমি চলেছি, আমার সঙ্গে সঙ্গে চাঁদও চলেছে। উটের মতো আকাশের দিকে মুখ করে হাঁটতে হাঁটতে আমার মনে পড়ল ,আজ যাবার সময় দেখেছিলাম ,রাস্তার কয়েকটা ম্যানহোলের ঢাকা ছিল না। নিশ্চয় ওগুলো হাঁ করে জলের তলায় ওত পেতে আছে আমাকে পাতালে পাঠাবার অপেক্ষায়। ভীষণ ভয় করছে এখন ।চাঁদ আমার মাথার থাকুক। খুব সাবধানে পা ফেলে এগোতে হবে।

পথের সাথী :

রাস্তায় আমি শুধু একা। পা দুটো অসাড় হয়ে আসছে। আর হাঁটতে পারছি না। বুকের দম যেন ফুরিয়ে আসছে। কিছু দূর এগিয়ে মনে হলো, কে যেন অন্ধকারে আমার পেছনে পেছনে আসছে। মনে বল পেলাম। নিঃসঙ্গ অন্ধকার জলমগ্ন রাস্তায় একজন সঙ্গী পাওয়া সত্যি ভাগ্যের কথা। তাকে দেখে আমার পায়ের গতি আপনার থেকেই একটু মন্থর হয়ে গেল। লোকটা কোনো কথা বলল না। অথচ সোজা আমার পাশে পাশে হেঁটে চলেছে ।এখন আমার কেমন যেন সন্দেহ হল। ভয়ে গায়ে কাঁটা দিল। লোকটার মুখের দিকে তাকাতে ও ভরসা পাচ্ছি না। কি জানি, কি দেখতে কি দেখব! আমি আর চুপ করে থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করে বসলাম তার গন্তব্যস্থলের কথা ।সে আমাদের পাড়ার নাম বলল ।আমাদের পাড়ায় থাকে লোকটা ? ঠিকানা কি? আশ্চর্য, লোকটা দেখি আমার ঠিকানা বলল। এবার আমি তার নাম জিজ্ঞাসা করলাম। নাম ? আশ্চর্য! আমার জীবনের সবচেয়ে অবিশ্বাস্য ব্যাপার! আমার নামটাই উচ্চারণ করল সে। প্রথমে তো আমি আমার কান দুটোকেই বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি ।আমি ভুল শুনছি না তো?

উপসংহার :

প্রায় চেতনা হারিয়ে ফেলেছিলাম। চেতনা যখন ফিরল ,তখন দেখি, আমি আমাদের পাড়ার চৌ-রাস্তার মোড়ে পৌঁছে গেছি। আর কি আশ্চর্য রসিকতা! জল ঠেলে বাড়ির দরজার সামনে পৌঁছেছি, এমন সময় চারদিকের আলো জ্বলে উঠলো। কলকাতা বিদ্যুৎ সরবরাহ সংস্থা বাস্তবিক রসিকতা জানে ।মা দরজা খুলেই রেখেছিলেন ।ওপরে নিজের ঘরে এসে দেখি , আমার বিছানায় অর্ঘ্য খুব আরামে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে ।



সমাপ্ত 


আরো পড়ুন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts
Scroll to Top