ভূমিকা:
ইতিহাস অতীতের নীরব সাক্ষী। যুগ যুগান্তর ঘরে যেখানে যা কিছু ঘটেছে ইতিহাস সে ঘটনাপুঞ্জ কে তার সংগ্রহশালায় পরম যত্নে সাজিয়ে রেখেছে— কাউকেই অপ্রয়োজনীয় বলে উপেক্ষায় অনাদরে বর্জন করেনি। মহাকালের স্রোতধারায় কত সভ্যতা-সংস্কৃতির উদয় ও বিলয় হয়েছে, তার কত স্মৃতি, কত ঘটনাপুঞ্জের কাহিনী সকলে ভুলেছে, কিন্তু ইতিহাস অতীত- বর্তমান – ভবিষ্যতের মিলন সেতু। অতীত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে সে বর্তমান মানুষকে শিক্ষা দেয়, আবার বর্তমান ঘটনার আলোকে ভবিষ্যৎ মানুষকে পথ দেখায়।
মৃত, ইতিহাস পাঠ অনাবশ্যক:
অনেকের মতে ইতিহাস মৃত, নির্বাক, মূক। তারা মনে করে বিস্মিত মৃত অতীতকে নিয়ে ইতিহাসের কাজ করবার যে – অতীতকে না জানলে, না চিনলে, না বুঝলেও বর্তমান মানুষের জীবনযাত্রায় কিছু যায় আসে না। তাদের অভিমত হল– অতীতের অন্ধকারে নিমজ্জিত নিষ্প্রাণ ঘটনাবলীকে জেনে কি লাভ? হরপ্পা মহেন-জো-দারোর নগর পরিকল্পনা কেমন ছিল, তখনকার মানুষ কোন দেব দেবীর আরাধনা করত, তাদের ব্যবহৃত অলংকার বলি কেমন ছিল– বর্তমান যান্ত্রিক যুগে এসব কাহিনী জানার সার্থকতা কোথায়? যেখানে দু-বেলা দুমুঠো অন্নের সংস্থান করতে মানুষকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়, ‘দিনযাপনের’ ও ‘প্রাণ ধারণের’ গ্লানি নিয়ে জীবন ধারা বয়ে চলে, সেখানে ইতিহাস পাঠের মূল্য কি?
ইতিহাস পাঠের উপযোগিতা:
যে মানব সভ্যতা সংস্কৃতি আমরা আজ দেখছি ,তা একদিনে গড়ে ওঠেনি। বহু যুগের উত্থান-পতনের বন্ধুর পথ অতিক্রম করে তবে তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অতীতের প্রভাব,প্রেরণা ও শিক্ষা বর্তমানের ভিত্তিকে করেছে সুদৃঢ়। শৈশব-কৈশোর-যৌবনের দিনগুলিকে বাদ দিয়ে আমরা কি পরিণত প্রৌঢ়ত্বকে কল্পনা করতে পারি? অতীত ইতিহাস কে বাদ দিয়ে একটি জাতির বা একটি রাষ্ট্রের সামগ্রিক পরিচয় লাভ কি সম্ভব? যে জাতির ইতিহাস যত সমৃদ্ধ, সে জাতি তত উন্নত। ইতিহাসের অতীত শিক্ষা, জ্ঞান, সত্য -উপলব্ধি জাতিকে দুর্দিনের পথ দেখায়। সে জাতির “Friend,philosopher and guide” । তার প্রদত্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার উপর সাহিত্য- দর্শন- কাব্য কলা —বিবিধ শিল্পের বহু কক্ষবিশিষ্ট বিশাল ইমারত প্রতিষ্টিত। ইতিহাসের দর্পণেই জাতির সম্যক আত্ম দর্শন সম্ভব।
স্বদেশী আন্দোলনের প্রেরণা দান:
দেশকে জানতে হলে, চিনতে হলে দেশের ইতিহাসের সঙ্গে সর্বাগ্রে পরিচিত হতে হয়। জাতির রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ধর্মনীতি- যেকোনো বিষয়ে জানতে হলে ,শিখতে হলে ইতিহাসের অনুশীলন ও চর্চা অত্যাবশ্যক। আমাদের স্বদেশী আন্দোলনে ইতিহাসই যুগিয়েছে প্রেরণা –উদ্বুদ্ধ করেছে দেশপ্রেমে। রানা প্রতাপ এর স্বাধীনতা সংগ্রাম, বাংলার প্রতাপাদিত্য- ঈশা খাঁর স্বাধীনতাপ্রিয়তা-ও শৌর্য-বীর্য জাতির মনে জাগিয়েছে উৎসাহ-উদ্দীপনা। সতীত্ব রক্ষা ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য রাজপুত রমণীদের আত্মত্যাগ, লক্ষী বাই- দুর্গাবতীর বীরত্ব ভারতীয় নারী সমাজকে যুগে যুগে সাহসিকতা ও মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত করেছে। অগ্নিযুগের বীর সন্তানদের আত্মত্যাগ, স্বাধীনতার বীর শহীদদের আত্মাহুতি জাতির অন্তরকে গৌরব ও মহিমার আলোকে প্রদীপ্ত করেছে।
ইতিহাস প্রণেতার দায়িত্ব-কর্তব্য:
ইতিহাস অতীত কাহিনী শোনায়। ইতিহাস মূল্যবান উপাদান সংগ্রহ করে মানুষের জ্ঞান ভান্ডার কে পূর্ণ করে। তার অনুশীলন ও চর্চার মধ্য দিয়ে কেবল রাজনৈতিক জ্ঞান লাভ নয়, জাতির ক্রমবিকাশ ও ক্রমোন্নতির সম্যক পরিচয় মেলে। আমাদের মত আত্মবিস্মৃত জাতির ইতিহাস সংকলনের প্রয়োজন সর্বাধিক। ইতিহাসের অভান্ত সত্য উপলব্ধি জাতীয় সর্ববিধ মোহ মুক্তি ঘটাতে পারে। ইতিহাস প্রণেতার দায়িত্ব ও কর্তব্য তাই অনেক –তাকেও সত্যদ্রষ্টা ঋষির মতো সত্যানুসন্ধানের কঠোর সাধনায় ব্রতী হতে হয়। তাছাড়া বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ইতিহাসের উপাদান সমূহ লিপিবদ্ধ হওয়া উচিত।
ইতিহাসের শিক্ষা:
ইতিহাস সুদূরের অতীতকে বর্তমানের মধ্যে হাজির করে। দূরকে করে নিকট। অজানাকে জানায়। অপরিচিতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেখিয়ে দেয় অতীতে কি ছিল, এখন কি হয়েছে, সতর্ক না হলে ভবিষ্যতে কী শোচনীয় পরিণতি হতে পারে? প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীভৎস ধ্বংসলীলার ইতিহাস বিশ্ববাসীকে সজাগ ও সতর্ক না করলে এতদিনে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের লেলিহান অগ্নি শিখায় এত সুন্দর পৃথিবী, তার সভ্যতা-সংস্কৃতি শ্মশানে পরিণত হতো। অতীতের শোষণ– শাসন, উৎপীড়ন- অত্যাচার মানুষের কি দুঃসহ- দুর্গতির কারণ হয়েছিল, ইতিহাসের কাছে মানুষ সে শিক্ষা পেয়েছে বলে যাতে ইতিহাসে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি দিতে পেরেছে। ইতিহাস আরও জানিয়েছে –শক্তি আর অহংকারে মত্ত হয়ে কেউ অমরত্ব অর্জন করেনি। মহাকালের ধারায় সবকিছু অবলুপ্ত হয়েছে।
উপসংহার:
ইতিহাস তাই যুগ-যুগান্তরের অনির্বাণ ধ্রুবতারা। তার জ্যোতির্ময় আলোক শিখা অভ্রান্ত পথের দিশারী— সুন্দরতম জীবনের পথিকৃত। সুখে- দুঃখে, সুদিনে -দুর্দিনে সে বিশ্বমানব কে পথ দেখাচ্ছে। সে মৃত নয়, তার শিক্ষা ব্যর্থ নয়, মিথ্যা নয়– তার চর্চা ও অনুশীলন অপরিহার্য।