পরিবেশ রক্ষায় ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা(The role of students in protecting the environment)

ভূমিকা

মাতৃজঠরে মানব শিশুর জন্ম ঘটলেও প্রকৃতপক্ষে তার জন্ম ঘটে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর। অন্ধকার মাতৃগর্ভ থেকে নানা পরিবেশে তার জীবনের বিকাশ ঘটতে থাকে। পরিবেশ কথাটির অর্থ খুবই ব্যাপক এবং সুদুরপ্রসারী। পারিবারিক পরিবেশ, সামাজিক পরিবেশ, শিক্ষার পরিবেশ, জাতীয় সংস্কৃতির আদর্শ, সব মিলিয়ে এক অখণ্ড জীবনচেতনা তারই নাম পরিবেশ ।মানুষের চরিত্র গঠনে আর তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও চিত্রপ্রকর্ষের অভিব্যক্তিতে পরিবেশের বিরাট প্রভাব থাকে। বলতে গেলে পরিবেশই তার জীবনের নিয়ন্ত্রণ শক্তি। ভিন্ন ভিন্ন ভৌগলিক আবেষটনীতে এক একটি দেশের স্বতন্ত্র পরিবেশ তৈরি হয় এবং তা সে দেশের মানুষের চরিত্রের উপর বিশেষভাবে ক্রিয়াশীল।

পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ

শিশু প্রথমে তার বাবা-মার ঘরে জন্মগ্রহণ করে। মা-বাবা ও সেই বংশের বংশানুক্রমিক জীবনাদর্শ তার উপর প্রভাব বিস্তার করে। মা বাবা ও তার পরিবেশ এর আরও পাঁচ জন লোকের সান্নিধ্যে, স্নেহে, সৌহার্দ্য ও ভালবাসায় তার জীবন বর্ধিত হয় ।পরিবারটি যদি শিক্ষিত আদর্শবাদী ও সুরুচিসম্পন্ন হয় তবে শিশুর উপর সেই গুনগুলি বর্তাবে ।আবার পরিবারটি যদি ভিন্ন রূপ অর্থাৎ স্বার্থপর, লোভী ও পরশ্রীকাতর হয় তবে নবজাতক শিশুটি ধীরে ধীরে সেই সমস্ত দোষের অধিকারী হয়ে উঠবে।

অবশ্য বংশগত শিক্ষা-দীক্ষার আদর্শ যাই হোক না কেন, যদি শিশুটি আদর্শ বিদ্যালয়এ পড়াশোনার সুযোগ পায় তবে সেই শিক্ষা নৈতিক পরিবেশ তার মনে সদগুণের প্রভাব সঞ্চার করতে পারে।

প্রাকৃতিক পরিবেশ

মানুষের জীবনের বিকাশ ও মনুষ্যত্বের পূর্ণতার জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে এসে মানুষ জরত্ব কালিমা পরিহার করে সত্য ও সুন্দরের নির্মল প্রাণধারায় স্নাত হয়।

শিক্ষা পায় সহজ জীবনের। প্রকৃতি মানুষের অন্যতম শিক্ষাগুরু । প্রাচীন ভারতের তাই শিক্ষায় তপবন কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল । প্রাচীন ভারতের ঋষিরা বিশ্বপ্রকৃতির প্রাঙ্গণে ছাত্রদের বিশ্বমানবতার শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষের প্রধান শিক্ষকের মানবতার শিক্ষা মানুষের মানুষের নিবিড় ঐক্য বদ্ধনেই মানবতার আদর্শে পূজিত হয় ।মানুষকে তাই সমাজ মুখি হতে হবে এবং এ কাজে ব্রতী হবার জন্য আদর্শ হলো ছাত্রসমাজ। সমাজের সকলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সমাজের অঙ্গ থেকে কালিমা গুলিকে মোচন করার অভিপ্রায় নিয়ে তরুণ ছাত্র সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। ভারতবর্ষের সভ্যতার যে সনাতন বৈশিষ্ট্য, বিভিন্নতার মধ্যে ঐক্য ও মানবতার আদর্শ চর্চা, আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনের পরিবেশের মধ্যে তা জাজ্বল্যমান।

পরিবেশে প্রভাব

মনে রাখা প্রয়োজন, যে শিশু প্রথম কথা বলতে শিখছে- তার ওপর পরিবেশের প্রভাব ব্যাপক। ধনী ব্যক্তিরা বিলাস ব‍্যসনে অমিতাচারী জীবন কাটায় বলে সেই পরিবেশে বর্ধিত হয়ে তাদের শিশুরা তদনুরূপ দোষের অধিকারী হয়। আর দরিদ্র শিশুরা শিক্ষাদীক্ষা না পেয়ে বেপরোয়া ও স্থূল রুচির অধিকারী হয়, কিন্তু মা বাবার মত তারা হয় কর্মঠ ও আত্মনির্ভরশীল। আবার ভালো লোক কিছুদিন দুর্জন ব্যক্তিদের সঙ্গে মেলামেশা করলে দুর্জন হয়ে ওঠে। পক্ষান্তরে দুর্জন ব্যক্তি সাধুসঙ্গ লাভ করলে তার চিত্ত ভালোর দিকে ব্যথিত হয়। আসল কথা, ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশের প্রভাবে ভালো-মন্দ ভিন্ন স্বভাবের চরিত্র গড়ে ওঠে। এককথায় পরিবেশকে স্বচ্ছন্দ, সুন্দর, সুরুচিশীল, বলিষ্ঠ, আদর্শ সম্পন্ন ও সংস্কৃতিবান করে তোলা প্রত্যেকেরই নৈতিক কর্তব্য। তাহলে যে কোন স্বাধীন দেশ গৌরব কৃতিত্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। আমাদের দেশের লোকেরা পল্লীবাসী ও শহরবাসী। উভয় ক্ষেত্রেই আজ নোংরামির পরিবেশ রচিত হয়েছে। অশিক্ষা,কুশিক্ষা ও অন্ধ সংস্কার তো আছেই– তাছাড়া ব্যাক্তিস্বার্থ, রাজনৈতিক দলাদলি হিংসা ও খুন- জখমে এক পঙ্কিল কদর্য পরিবেশ রচিত হয়েছে সর্বত্র। দেশের সরকার ও প্রত্যেক নাগরিককে মানবতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। সব নোংরামি সরিয়ে ফেলে আমাদের সামাজিক, পারিবারিক ও রাজনৈতিক পরিবেশকে সুন্দর করে তুলে মনুষ্যত্বের জয়ধ্বজা কে উড্ডীন রাখতে হবে।

পরিবেশ ও সমাজ রক্ষায় ছাত্র সমাজ

ভারতের ছাত্র সমাজ প্রাণশক্তিতে ভরপুর। শিক্ষা অর্জন করাই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য হলে ও দেশ, সমাজ এবং পরিবেশের প্রতিও তাদের দৃষ্টি দিতে হবে। ভবিষ্যত দেশের বনিয়াদ গড়ে দেয় ছাত্রসমাজ। আগেই বলা হয়েছে ভারতবর্ষ পল্লী প্রধান দেশ ।পল্লির অগণিত মানুষ এখনো নিরক্ষর অশিক্ষিত। অশিক্ষা দেশ ও সমাজের পক্ষে এক বিরাট অভিশাপ। অশিক্ষা কুসংস্কারের অভিশাপের অভিশপ্ত হয় পরিবেশ। শান্তি হয় বিঘ্নিত। সমাজের মানুষকে নিরক্ষতার অভিশাপ মুক্ত করতে ছাত্রসমাজকে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সঙ্গে দেশের অখন্ডতার আদর্শ প্রচার করে তাদের মধ্যে স্বদেশ প্রেম জাগ্রত করতে হবে। সর্বোপরি প্রয়োজন পল্লি সংস্কার। গ্রামে গ্রামে শিক্ষা বিস্তার ,পুস্করিণীর সংস্কার ও রাস্তা-ঘাট নির্মাণ, কুটির শিল্পের পুনরুজ্জীবনের দ্বারা পল্লীর প্রভূত উন্নতি সাধিত হবে, গড়ে উঠবে সুস্থ-স্বাভাবিক বাসযোগ্য পরিবেশ। অবসর মতো ছাত্ররা পল্লির সংস্কার ও গ্রাম পুনর্গঠন কর্মে নিষ্ঠা সহকারে ব্রতি হলে দেশ, সমাজ ও সুস্থ সামাজিক পরিবেশ গড়ে উঠবে তাতে সন্দেহ নেই। সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসতে পারে ছাত্রসমাজ।

উপসংহার

গণতান্ত্রিক দেশের সকলকেই স্মরণ রাখতে হবে, পরিবেশই সবকিছু। তা জীবনের আশীর্বাদ বা অভিশাপ দুইই হতে পারে। পরিবেশ মানুষকে পশু ও করতে পারে, দেবতাও করতে পারে। পরিবেশের সুফলও আছে,কুফল ও আছে। যেদিকে সুফল সে রকম পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। মানুষ হিসেবে মানুষের জন্য মানুষের দায়িত্ব অসীম। আমরা যেন মনে রাখি, মানবতার বিপুল নীড় রচনার ভার রয়েছে মানুষের ওপর –‘আমার উপরে দিয়েছো তোমার স্বর্গ রচার ভার।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts
Scroll to Top