তোমার জীবনের লক্ষ্য (The Goal of Your Life)

ভূমিকা:

গন্তব্য স্থল নির্দিষ্ট থাকলে কান্ডারী শক্ত হাতে হাল ধরে তরঙ্গ ক্ষুব্দ দুস্তর সমুদ্র পাড়ি দিয়ে একসময় না একসময় তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। আমাদের জীবন সমুদ্র তুল্য। তাতে পদে পদে বাধা বিপত্তির ঝড়ঝঞ্জা, প্রতিকূল শক্তির তরঙ্গ বিক্ষোভ। এসব বিরুদ্ধ শক্তিকে অতিক্রম করে জীবন লক্ষ্যে উপনীত হতে পারলে জীবন হয় সার্থক। অপরপক্ষে লক্ষ্যহীন তরী এপথে- ওপথে, এঘাটে-ওঘাটে এলোমেলো ভাবে চলতে চলতে একসময় দিগভ্রান্ত হয়ে সলিল সমাধি প্রাপ্ত হয়। কাজেই জীবনের লক্ষ্য আগেভাগে স্থির হওয়া বাঞ্ছনীয়।

ছাত্রাবস্থাই লক্ষ্য নির্ণয়ের যথার্থ সময়:

ছাত্রজীবন পরিণত জীবনের প্রস্তুতিপর্ব। ছাত্রাবাস্থার স্বপ্ন ও কল্পনা পরিণত জীবনে বাস্তবের মাটিতে ফলে ফুলে সুশোভিত হয়ে সার্থক হয়। কিন্তু কল্পনা অবাস্তব হলে চলে না, পরিণত জীবনের লক্ষ্যবাহী হওয়া চাই। সেজন্যে ছাত্রাবাস্থাতে জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে হয়। ছাত্র জীবনে আমি যখন স্বপ্ন দেখতে ও কল্পনা করতে শিখলাম তখনই আমার স্বপ্নচারী মনে যেন এক ঝলক আলো ছড়িয়ে দিয়ে বাবা জানালেন – আমি হব ডাক্তার। ডাক্তার হব – বাবার ইচ্ছা আর আমার স্বপ্নের মধ্যে দেখলাম অপূর্ব মিল।

পাঠক্রম নির্বাচন:

পাঠ্য জীবনের শুরু থেকে চলেছে বাবার চেষ্টা আর আমার অধ্যবসায় ও সাধনা। নতুন শিক্ষা পদ্ধতি অনুযায়ী মাধ্যমিক পর্যায় শেষ করে একাদশ শ্রেণীতে বেছে নিতে হবে পাঠক্রম। একাদশ শ্রেণীতে এসে অনেকেই পাঠক্রম নির্বাচন করতে বেগ পেতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে ছাত্রের অনিচ্ছাসত্ত্বেও অভিভাবকেরা জোর করে পাঠক্রম চাপিয়ে দেন। ফলে তাতে ভালো হয় না। পূর্বাহ্নে আমার লক্ষ্য স্থির থাকায় আমাকে পাঠক্রম নির্বাচনে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হবে না। চিকিৎসা শাস্ত্র বিজ্ঞানের এক বিশিষ্ট অঙ্গ। একাদশ শ্রেণীতে স্বাভাবিকভাবে বিজ্ঞানের ছাত্র হব। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে জয়েন্ট এন্ট্রান্সের ছাড়পত্র নিয়ে শুরু হবে মেডিকেল কোর্সের অধ্যায়ন। প্রি- মেডিকেল কোর্স পড়ার পর শুরু হবেএম.বি.বি.এস. কোর্স। চলবে সত্যিকারের ডাক্তার হওয়ার সাধনা। একদিন ডাক্তার হয়ে জীবনের লক্ষ্যে উপনীত হব।

বিশেষ লক্ষ্য নির্বাচনের পিছনে যুক্তি:

ডাক্তার হওয়ার পথই আমি নির্বাচন করেছি। অবিশ্যি আমার নির্বাচনের পিছনে আছে মহৎ উদ্দেশ্য। আমি গ্রামাঞ্চলের ছেলে। আবাল্য দেখেছি গ্রামগুলিকে অনাদরে অবহেলায় পড়ে থাকতে। সেখানকার মানুষের দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য সেইসঙ্গে চিকিৎসা ডাক্তারের অভাব আমাকে পিরিত করেছে। মৃত্যুর বীভতস লীলায় হয়েছি কাতর। সেই থেকে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছি বড় হয়ে ডাক্তার হব। গ্রাম হবে আমার কর্মক্ষেত্র। আর পাঁচজন শিক্ষিত মানুষের মতো শহরের সুখ-সুবিধা ও অর্থ উপার্জনের প্রলোভনে শহরমুখী হব না। দরিদ্র গ্রামবাসীর সেবাই হবে আমার জীবনের ব্রত।

লক্ষ্যকে সার্থক করার কর্মপন্থা :

নিরক্ষর গ্রামবাসীর স্বাস্থ্য বিষয়ে অজ্ঞতার ফলে গ্রামের পর গ্রাম কলেরা বসন্তের মতো সংক্রামক ব্যাধির শিকার হয়ে শ্মশানে পরিণত হয়। শত শত মানুষের প্রাণহানি ঘটে ।এই মরণ যজ্ঞ থেকে উদ্ধার পেতে গ্রামবাসীকে দেব শিক্ষা ও পরামর্শ। সংক্রামক ব্যাধির সূচনাতেই গ্রহণ করব সবরকম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। অকাল মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করব তাদের। সরকারি অর্থানুকূল্যে দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তুলবো তাদের জন্যে, যারা দুবেলা-দুমুঠো খাবার যোগাড় করতে পারে না,পারে না টাকার অভাবে রোগের চিকিৎসা করাতে। আর্তের সেবাই হবে আমার মহান ব্রত। রোগীর বাড়ি থেকে ডাক এলেই ঝড়ঝঞ্ঝা,অন্ধকার রাত্রি, গ্রাম্য পথের অসুবিধা সবকিছু উপেক্ষা করে রওনা হব অম্লান বদনে। নিজের ভোগ সুখের চেয়ে একটি জীবনের মূল্য অনেক বেশি। পরার্থে আত্মোৎস্বর্গেই জীবনের চরম সার্থকতা।

উপসংহার:

আমরা আজ মহৎ কিছু ভাবতে ভুলেছি কেউ ভাবলে তা হয় উপহাসের বস্তু।আশঙ্কা হয়, আমার মহৎ বাসনা শুনে অনেকে হয়তো অনুরূপ উপহাস করবেন। জানি, আজ যা আমার স্বপ্ন, তা একদিন বাস্তবায়িত হয়ে সফল হবে। গ্রামবাসীর দারিদ্র্য- অশিক্ষা দূর করার ক্ষমতা আমার নেই, কিন্তু চিকিৎসাহীন মৃত্যু থেকে রক্ষা করার শক্তি ও দক্ষতা আসবে আমার– একথা ভেবে অমেয় আনন্দধারায় পূতস্নান করছে আমার হৃদয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts
Scroll to Top