“বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।
দেশে দেশে কত না নগর রাজধানী মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু
কত না অজানা জীব, কত না অপরিচিত তবু রয়ে গেল অগোচরে।”
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভূমিকা
অজানাকে জানার,অচেনাকে চেনার ইচ্ছা মানব মনের অনন্তকালের সঙ্গী । প্রাত্যহিকতার গ্লানি অপনোদনের বাসনায় মানবমন নিরন্তর নতুন প্রকৃতির সন্ধানে আত্মহারা হয়ে ওঠে। আর তখনই নতুনকে আবিষ্কারের নেশায় নিত্যনতুন দেশ ভ্রমণের মাধ্যমে মানবমন লাভ করে শিক্ষা ও আনন্দ।
ভ্রমণের মাধ্যমে শিক্ষার প্রাচীন ইতিহাস
প্রাচীনকালে জ্ঞান চর্চার সীমিত ক্ষেত্রও উপকরণের বৈপুল্যের অভাব মানুষের ভ্রমণপিপাসু মনকে উসকে দেয়। জ্ঞানার্থী মানুষের দল পরোক্ষভাবে জ্ঞানলাভের বস্তুর অভাবে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার নেশায় পাড়ি জমাতে থাকে অন্যান্য স্থানে, বিভিন্ন দেশে। শারীরিক কষ্ট, দস্যু ভয়, পথের বন্ধুরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কোন কিছুই তাদের উদ্দাম চলার নেশাকে প্রতিহত করতে পারেনি। ভারতভূমি তাই ধন্য হয়েছে বহু জ্ঞানী ও জ্ঞানান্বেষণকারী পর্যটক শিক্ষার্থী ও বৌদ্ধ- দার্শনিক তথা বৌদ্ধ- ভিক্ষুর পাদস্পর্শে।
ভ্রমণের মাধ্যমে শিক্ষা লাভ
জ্ঞান ভান্ডারের বৃহদংশ পুস্তকের জগত থেকে হয়। কিন্তু বইয়ের পঠন-পাঠন আমাদের মনের গভীরতা কে স্পর্শ করতে পারে না।তাছাড়া শেক্সপিয়ারের বক্তব্য –
” home keeping youths ever have homely wits”
– কথাটি সর্বান্তকরণে সত্য। গৃহাভ্যন্তরে নিশিদিন যাপনকারী যুবকের হৃদয় সংকীর্ণ ও কুপমন্ডুক হয়ে ওঠে। অনন্ত প্রসারিত বিশ্বের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমাদের চিন্তা ভাবনা পরিধিকে বাড়িয়ে দেয়, আর তখনই লব্ধ হয় প্রকৃত জ্ঞান।
পাঠ্যবস্তু পাঠে ভ্রমণের অপরিহার্যতা
ভ্রমন জনিত অভিজ্ঞতার আলোচনা হয়ে ওঠে ইতিহাস-ভূগোল নৃতত্ত্ব । ইতিহাসের বইয়ের আবদ্ধ ফা-হিয়েন হিউয়েন সাঙ কিংবা মেগাস্থিনিস ও অতীশ দীপঙ্করের ভ্রমণ বর্ণনা প্রত্যক্ষ দর্শন জীবন্ত হয়ে ওঠে, জ্বলন্ত রূপ ধারণ করে ঐতিহাসিক স্থান গুলির বর্ণনা। এইভাবে ভূগোল বইগুলিতে বাঁধাপড়া অসংখ্য জাল বিস্তার নদী, আফ্রিকার গহন অরণ্য থেকে হিমালয়ের অভ্রংলিহ সত্তার জাগ্রত কায়া- সবাই ম্যাপের সীমানা পেরিয়ে নিজের অস্তিত্ব সহযোগে ধরা দেয় আমাদের দৃষ্টিপথে। ইতিহাস -ভূগোল এর গ্রন্থবদ্ধ কথা কাহিনী আমাদের সমক্ষে যখন প্রকৃতরূপে প্রতিভাসিত হয় তখন সম্পূর্ণতা আর লাভ করা আমাদের শিক্ষালাভের প্রয়াস।
সংস্কৃতির সমৃদ্ধি ও দেশ ভ্রমন
দেশভ্রমণের ফলে আমাদের সাহিত্য ভান্ডারও সংযোজিত হয় নব নব সৃষ্টি। ভ্রমণকাহিনী অবলম্বনে বিশিষ্ট ভ্রমণসাহিত্য অতীত ও বর্তমানের মাঝে সেতুবন্ধন রচনা করে। ফা-হিয়েন মেগাস্থিনিসের বর্ণনা থেকে শুরু করে আধুনিক কালের রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণমূলক রচনাবলি সমৃদ্ধ করেছে ভারতীয় সাহিত্যক্ষেত্রেকে ও সেইসঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতিকে।
বিশ্বশান্তির বার্তাবহন
বর্তমান বস্তুবিশ্বে চলমান শক্তির প্রতিযোগিতার লড়াইয়ের মাঝে দেশ ভ্রমণ কিংবা বিদেশ ভ্রমণে আনছে শান্তির বার্তা । ভ্রমণের ফলে ভিনদেশী মানুষেরা পরস্পরের সান্নিধ্য লাভ করায় নিষ্ঠুর প্রাচীর ঘুচিয়ে দিয়ে শুভবোধের উন্নতি হতে পারবে। এর ফলে আন্তর্জাতিক তথা জাতীয় ক্ষেত্রে সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্বের সৌধ রচিত হবে। বস্তুত, এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তর সমাজে বিশ্বশান্তি দামামা সম্ভবপর হবে একমাত্র ভ্রমণের কল্যাণে।
আর্থিক উন্নয়নের ভূমিকা
ভ্রমণকে অবলম্বন করে দেশেের পর্যটন শিল্পের বিকাশ থেকে অর্থগমের পথ প্রশস্ত করছে। পর্যটন শিল্প বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশের ধনভান্ডার স্ফীত করেছে, দেশি- বিদেশি পর্যটকদের গমনাগমনে বৈদেশিক মুদ্রার আগম ঘটছে , দর্শনীয় স্থান গুলি ও স্থানীয় হোটেলগুলির শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে।
উপসংহার
বর্তমান যুগে বিজ্ঞানের বিজয় বৈজন্তীর সময়ে বৈরাগ্ঙিক সমৃদ্ধির জয়গাথা রচিত হচ্ছে অন্তরের ভগ্নদশাপ্রাপ্ত শিলাস্তরের উপর।তাই বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ভ্রমণ একান্ত অপরিহার্য। চির অচেনার মাঝে অজানা সঙ্গীগুলি যখন একসঙ্গে চলতে শুরু করে তখন দূর হয়ে ওঠে নিকট, পর হয়ে ওঠে আপন। ফলে আমরা আমাদের ভ্রমণসঙ্গীকে কে অবলম্বন করেই বিশ্বমৈত্রীর পথে এগিয়ে যাযই ও তৃপ্ত করি আমাদের চির- জিজ্ঞাসু, চির- পিপাসু মনকে।