“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে ”
-জীবনানন্দ দাশ
ভূমিকা:-
রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নাটকের কিশোর নায়ক অমল অত্যন্ত ভয়ের সাথে বলেছিল পিসেমশাই আমাকে পন্ডিত হতে বলো না। কবিগুরু পরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থা নিছক পণ্ডিতের কোন স্থান নেই। শুধুমাত্র যিনি পন্ডিত তিনি বইয়ের পোকা পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে কোন কথা বলেন না , বোঝেন না এবং শিক্ষক রূপে তার বাইরে কিছু বোঝাতেও চাননা। পুঁথিগত বিদ্যাধর এরা খাঁটি অর্থে শিক্ষিত নয়।
ভ্রমণ পিপাসু মানুষ:-
প্থিক প্রাণ মানুষের পথ চলার শেষ নেই। অন্তহীন তার যাত্রা। সে নিজের পরিচিত গণ্ডির মধ্যে থেকেই বাইরে যেতে চায়। দুর্গম তুষার গিরি দক্ষিণ মেরুর ঊর্ধ্বে অজ্ঞাত বিষয়, মহাপ্লাবী প্রচন্ড নির্ঝর তার সুদুরপ্রসারী মনকে আকর্ষণ করে। তার অতন্দ্র রাত্রির অনিমেষ চোখে বুলিয়ে দেয় আনন্দের মহাঞ্জন স্পর্শ। তাই বিবাগী মানুষ ঘরের নিশ্চিত সুখ-শান্তি আরামের মায়া বন্ধন উপেক্ষা করে ঝাঁপিয়ে পড়ে বর্ণী বিশ্বের বাধা বিপত্তি ভরা দ্বন্দ্ব সংঘাত ময় কঠোর জীবনে। ঘর ছেড়ে সে পথ কে করে ঘর। তার বিশ্ববিজয়ী মনের কৌতূহল স্পৃহা তাকে দেশ ভ্রমণে করে উদ্বুদ্ধ।
সেকালের দেশ ভ্রমণ:-
অতি প্রাচীনকাল থেকে দেশ ভ্রমণের সূচনা। তখন উপযুক্ত পথঘাট ছিল না ,ছিল না যানবাহনের সুযোগ সুবিধা। ছিল পদে-পদে প্রতিকূল শক্তির বাধা। কিন্তু তা সত্বেও মানুষের ভ্রমণ ইচ্ছা ছিল অপ্রতিহত। অজানাকে জানতে, অদেখাকে দেখার আনন্দে মানুষ জীবন পর্ন লড়াই করে বেরিয়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে। এভাবেই বিশ্বের বিচিত্র ময় সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়ার আনন্দে চীন থেকে ভারতে আসেন ফা- হিয়েন, হিউ এন সাঙ। সুদূর আফ্রিকা থেকে এসেছিলেন ইবন বতুতা। অপরদিকে জ্ঞান প্রচার ও জ্ঞানলাভের আনন্দে অতীশ দীপঙ্কর শ্রী জ্ঞান কাশ্যপ মাতঙ্গ প্রমুখেরা ভারত বর্ষ ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন। তেমনি ভাবে অজানা অচেনা দেশ আবিষ্কারের নেশায় ডেভিড লিভিংস্টোন, কলম্বাস, মার্কো পোলো প্রভৃতি পর্যটকগণ দুঃসাহসীক অভিযান করেছিলেন।
আনন্দে দেশ ভ্রমণ:-
পথের নেশায় এবং আনন্দ লাভের জন্য গৃহ সুখ মানুষের কাছে তুচ্ছ হয়ে গেছে। মানুষ ছুটে গেছে সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরে, গেছে দারুচিনি দ্বীপে, সবুজ বনানীর দেশে। দেশ-দেশান্তরে তার ছুটে চলার ক্লান্তিহীন ইতিহাস। আনন্দেরই নেশায় সে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে দুর্গমের অভিসারে। অফুরন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তুষার মৌলি উন্নত শীর্ষ হিমালয় এবং তার ধ্যানমগ্ন গিরি শৃঙ্গমালা সবই মানুষকে আকর্ষণ করে। আনন্দ পেতে ভ্রমণবিলাসী ছুটে যান ইতিহাসের ভগ্নাবশেষ বহু স্মৃতি মর্মরিত মুর্শিদাবাদে গৌড় পান্ডু রায়। কিংবা অজন্ত ইলোরায়। ঘুরে বেড়ায় অতীত বাণিজ্য বন্দর তাম্র লিপ্তের নির্জনতা ছুটে যায় বেলপাহাড়ি কাকড়াঝোড় এর আদিবাসী এলাকায় ভ্রমণপবিলাসীদের আহ্বান করে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা অনুপম স্থাপত্য গুহাচিত্র বা মন্দির মসজিদ গুলো।
শিক্ষার অঙ্গরূপে দেশ ভ্রমণ:-
দেশ ভ্রমণ শিক্ষার একটি অঙ্গরূপে স্বীকৃত। বই পড়ে যে শিক্ষা লাভ হয় তা অসম্পূর্ণ ও পরোক্ষ জ্ঞান। কিন্তু ভ্রমণের ফলে পুঁথিগত জ্ঞানের সঙ্গে বাস্তব অভিজ্ঞতা মিলে সমৃদ্ধ জ্ঞান লাভ করা যায়। কোন দেশ বা স্থানের ভৌগোলিক বিবরণ জলবায়ু ভূপ্রকৃতি এবং সেখানকার মানুষদের জীবনযাত্রা প্রণালী বইয়ের পাতায় পড়ি ঠিকই, কিন্তু সেই দেশ বা স্থান ভ্রমণ করলে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ সম্ভব। তেমনি ভ্রমণের ফলে ঐতিহাসিক বিষয়ে জ্ঞানের বিস্তার ঘটে। ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান গুলির সম্পর্কে পাঠ্যপুস্তকে যা লেখা থাকে তা খুবই অল্প। কিন্তু নালন্দা, রাজগির, আগ্রা, দিল্লি, সাসারাম ,ফতেপুর প্রভৃতি ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান ভ্রমণ করলে বাস্তব পরিচিত ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান অর্জনের সুবিধা হয়।
প্রকৃতপক্ষে অপরিণত বয়সের পুঁথি পড়া বিদ্যা শেষ হলে পরিণত বয়সে জীবনের নানা ক্ষেত্রে আসল শিক্ষা গ্রহণের সূত্রপাত হয়। দেশ ভ্রমণ মানুষকে জরতা থেকে মুক্ত করে একঘেয়েমি থেকে বাঁচায়। তাছাড়া দেশ ভ্রমণের ফলে অন্য ভাষাভাষীর সংস্পর্শে আসতে হয়। কথাবার্তার ফলে পারস্পরিক ভাষার আদান প্রদান ঘটে। এভাবে মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষা সম্বন্ধে অল্পবিস্তর জ্ঞান লাভ হয়।
দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ও মানসিক শান্তি লাভ:-
সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ভ্রমণ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটায় ও মনের ঔদার্য বোধ গড়ে তোলে ভাতৃত্ববোধের বিকাশ ঘটায়। মনে হয় সমগ্র দেশই নিজের দেশ। নিজেকে মনে হয় বিশাল দেশের নাগরিক। মনে একটি সমন্বয়বোধ আসে। ক্ষুদ্র জাতিভেদ প্রথা খাওয়া ছোঁয়ার সংকীর্ণতা সবকিছু মন থেকে অপসারিত হয়। নানা দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উৎসব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রভৃতি দেখার ফলে মানুষ খুঁজে পায় যেন বাঁচার আনন্দ। এর দারুন প্রশান্তি মনে সাড়া জাগায়।
উপসংহার:-
মনের ব্যাপ্তি মানেই জ্ঞানের ব্যাপ্তি। দেশ ভ্রমণের ফলে সেই জ্ঞান ও মনের প্রসারতা ঘটে। কবি টেনিসনের বহু বিখ্যাত চরিত্র ইউলিসিস এজন্য বৃদ্ধ বয়সেও ভ্রমণের ক্ষান্তি দেননি। ঘুরতে ঘুরতে তার ঘোরার পরিধি বেড়ে গেছে। যত চলেছেন তিনি দিগন্ত রেখা আরো ও সরে সরে গিয়ে বেড়ে গেছে– জীবনের শেষ তলানিটুকু ও তিনি নিঃশেষে পান করে নিতে চেয়েছেন। আজ ভারতের দিকে দিকে পর্যটনশিল্পের সম্ভার। দলে দলে দেশী-বিদেশী পর্যটকের দল ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের সর্বত্র। ছড়িয়ে পড়েছে অরণ্যে, পর্বতে, গুহায়, ইতিহাসের ধ্বংস ক্ষেত্রে। স্মৃতিবিজড়িত অতীত বর্তমানের শহরে, নগরে ,বন্দরে ,সমুদ্রসৈকতে অভিযাত্রিক এর নিত্য আনাগোনায়। সবাই আজ ভারত মা এবং তার যুগ প্রাচীন সভ্যতা সংস্কৃতি জানতে চায়। এটা অবশ্যই গর্বের ব্যাপার। গবেষণাগার ছাড়া বিজ্ঞান শিক্ষা যথাযথ হয় না। তাই দেশ ভ্রমণ কে বলা চলে শিক্ষার গবেষণাগার।
সমাপ্ত
আরো পড়ুন
- ভারতের বেকার সমস্যা (India’s Unemployment Problem) October 24, 2019
- মাতৃভাষায় শিক্ষাদান (Teaching Through Mother Language) October 23, 2019
- অরণ্য প্রাণী সংরক্ষণ (Wildlife Conservation) October 23, 2019