ভূমিকা
জল, যার অন্য নাম জীবন। যার অভাবে সমস্ত প্রাণী জগতে বেঁচে থাকতে পারে না । জীবকুলের জীবনে শক্তির উৎস এই নিরাকার তরল পদার্থ । বর্তমান বিজ্ঞাননির্ভর সভ্যতার যুগে মানুষ বিজ্ঞানের সহায়তায় অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কার তাদের দিয়েছে স্বাচ্ছন্দ, সুখ, বিলাসিতা, আরাম । কিন্তু আজ অবধি একটি জায়গায় হার স্বীকার করতেই হয়েছে । এখনো পর্যন্ত জলের বিকল্প আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। জল তৈরি করা সম্ভব হয়নি। প্রকৃতির দান, এই মহার্ঘ তরলটি
মানবদেহের জলের প্রয়োজনীয়তা
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে ফলের রস কিংবা দুধ, চা, কফির যা খাদ্যমূল্য অথবা পুষ্টিমূল্য রয়েছে জলের তা নেই। কাজেই অনেকর ধারণা পানীয় জলের মূল্যর বিচারে জলের বিকল্প অন্য কোন তরল হলেই চলে। এই ধারণা খুবই বিপদজনক। মানব দেহের প্রয়োজনীয় যাবতীয় ফ্লুইডের একটা বড় অংশই হলো জল। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দেহের ওজনের ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশই হলো জল। শরীরকে সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখার জন্য তাই একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক ২ থেকে ৪ লিটার জল পান করা উচিত। সুস্থ-অসুস্থ যেকোনো অবস্থাতেই প্রতিটি মানুষের পর্যাপ্ত পরিমান জল খাওয়া উচিত, এই কারণে যে আমাদের শরীর থেকে প্রতিনিয়ত জল বেরিয়ে যায় নানাভাবে। ঘাম, মল, মুত্র তো বটেই উপরন্তু মানবদেহে থেকে জল নিষ্কাশিত হয় নিশ্বাস এর মধ্য দিয়ে বাষ্পাকারে । মানবদেহে তরলের পরিমাণ যথাযত রাখতে জলের কোন বিকল্প নেই । মানুষের নানা শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপের মধ্যে সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে কিংবা ওইসব জৈবিক প্রক্রিয়া ভারসাম্য রাখার কাজে জলের ভূমিকা এবং গুরুত্ব অপরিসীম।জলের গুণেই মানবদেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকে । উপযুক্ত পরিমাণ জল খেলে মানুষের দেহে যে কোন ধরনের সংক্রমণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
জলের উৎস
জলের উৎস: প্রধানত তিনটি তিন রকম ভাবে আমরা জল পেয়ে থাকি । এগুলো হলো – বৃষ্টির জল, ভূগর্ভস্থ জল ও ভূপৃষ্ঠের জল। এই তিনটি উৎস থেকেই জল নিয়ে ব্যবহারের উপযোগী করে নেওয়া হয়। বহু পূর্বে বৃষ্টির জল ধরে নিয়ে তা ব্যবহার করা হতো। কিন্তু বর্তমানে দূষিত আবহাওয়ায় তা সম্ভব নয়। ভূগর্ভস্থ জল কে বর্তমানে উন্নত বিজ্ঞানভিত্তিক প্রথায় পাম্পের সাহায্যে মাটির নিচ থেকে তুলে তা পানের উপযোগী করে সরবরাহ করা হয়। বৃষ্টির জল গভীর নলকূপের জল ছাড়াও গঙ্গা বা নদীর জল বিভিন্নভাবে পরিশোধন করা হয়। বৃষ্টির জল, গভীর নলকূপের জল ছাড়াও গঙ্গা বা নদীর জল বিভিন্নভাবে পরিশোধন করে ফিল্টার বেডে থেকে ট্যাংক বা রিজার্ভার এ সংগ্রহ করে রাখা হয়ে থাকে। পরে সেটা পাইপের মাধ্যমে শহর বা শহরতলীতে সরবরাহ করা হয়। তবে কোন কারণে সেই পাইপ ফেটে গেলে সেই জল থেকে আবার নানা প্রকার রোগ জীবানু ছড়ায়।
জলের অপচয়
জল কে আমরা ব্যবহার করি খুবই অবহেলার সঙ্গে । আসলে যে জিনিসটা আমরা খুব সহজে পেয়ে থাকি তার মর্যাদা দিতে পারি না। এখনো পর্যন্ত জল আমাদের কাছে সহজলভ্য । কিন্তু সত্যিই কি তাই? পৃথিবীর লোক সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে । জনসংখ্যা যতই বাড়ছে, জলের ব্যবহার ও ততোই বাড়ছে। তার সঙ্গে সঙ্গেই বেড়ে চলেছে জলের অপচয়। প্রাত্যহিক জীবনে সাধারণত তিন রকম ভাবে জল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কৃষিক্ষেত্রে, কলকারখানায় এবং মানুষের ব্যবহারিক জীবনে। কৃষি ক্ষেত্রে জলের অপচয় হয় সবচেয়ে বেশি। তাই প্রথমে যদি কৃষি ক্ষেত্রে জলের অপচয় বন্ধ করা যায়, তবে কিছুটা সাশ্রয় হবে।
কৃষকেরা ফসল ভিত্তিক অর্থাৎ যখন যেমন জলের দরকার, তা না দিয়ে অথবা প্রযুক্তিগত জল ব্যবহার না করার ফলে জলের অপচয় বেশি হচ্ছে। তাই যে সমস্ত কৃষক চাষবাসের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত, তাদের জলের ব্যবহার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া প্রয়োজন। কৃষি ক্ষেত্র ছাড়াও কলকারখানায় জলের অপচয় বহুল পরিমাণে হয়ে থাকে। কারখানার কালি, ময়লা ও অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ নালীর মাধ্যমে সরাসরি নদী, পুকুর বা খাল-বিলে এসে পড়ে । ফলে সেখানকার জল দূষিত হয়ে যায় এবং তা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে ওঠে । আর আমরা আমাদের ব্যবহারিক জীবনে প্রচুর জলের অপচয় করে থাকি । আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের গড়ে 10 থেকে 12 লিটার জল খরচ করে থাকি । পৌরসভা পৌরনিগমের জলাধার থেকে কলের সাহায্যে বাড়ি বাড়ি জল দেওয়া হয় । কল খুলে নেওয়ার পর আমরা অনেকেই সেটা বন্ধ করতে ভুলে যাই । আর ভুলে গেলেও আপাতদৃষ্টিতে আমাদের কোনো ক্ষতি হয় না, কিন্তু প্রচুর জল নষ্ট হয় । প্রত্যেক পাড়ায় পৌরসভা ও পৌর নিগমের পক্ষ থেকে একাধিক জলের কল বা ট্যাপ ওয়াটার বসানো হয়ে থাকে। সময়ে সময়ে যখন জলাধার থেকে জল দেওয়া হয়, তখন দেখা যায় এইসব রাস্তার কলগুলি থেকে জল পড়ে যাচ্ছে। আমরা হয়তো পাশ দিয়ে যাবার সময় সেটা লক্ষ্য করছি, অথচ ওটা বন্ধ করার মত মানসিকতা আমাদের নেই। কিন্তু মনে রাখতে হবে এতে জলের অপচয় হচ্ছে।
জল সংকট
এই বেহিসাবি জলের অপচয় এর ফলে ধরিত্রী আজ চরম সংকটে। পৃথিবী আজ গরল কুম্ভে পরিণত হতে চলেছে । ছোট বড়ো নালা, নদী, পুকুর, ঝিল বা ভূগর্ভস্থ জল, যা প্রকৃতির অকৃপণ অবদান, ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। ভরে উঠছে লাগামছাড়া দূষণে। প্রাচীনকাল থেকেই বঙ্গজননী উদ্বৃত্ত জলের রাজ্য। সেখানেও শুরু হয়েছে চরম জল সংকট। জলের অপচয় পরিলক্ষিত হচ্ছে কি শহরে কি গ্রামে, আর সেটাই হলো পৃথিবীর জল সংকটের অন্যতম কারণ। পৃথিবীতে শতকরা ২০ জন লোক পানীয় জল থেকে বঞ্চিত। পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রাণ রক্ষার জন্য ত্রাণকর্তা জল। জল ভিত্তিক সভ্যতা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে চলে আসছে। যার সুনিশ্চিত ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি। সেকথা এতকাল কেউ ভাবেনি। জল সম্পর্কে সচেতনতা না থাকলে দেশের অবস্থা চরমে উঠবে। পৃথিবীর সমস্ত দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জল সংকটে পড়বে ভারত । এক দশকের মধ্যে চরম জলের মুখোমুখি হবে ভারত। বর্তমানে পৃথিবীর কয়টি দেশ জল সংকটে ভুগছে। আগামী 10 বছরে আরো 11 টি দেশ এই আওতায় আসবে , যার অন্যতম দেশ ভারত। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে 2025 থেকে ভারত এবং 2030 সাল থেকে সমস্ত পৃথিবী জল সংকটে ভুগবে। সবুজ বিপ্লব সফল হয়েছে ভূগর্ভস্থ জল এত বেশি পরিমাণে তোলা হয়েছে যে অগভীর টিউবওয়েলগুলো বেশিরভাগই জনশূন্য হয়ে পড়েছে। জলের অভাবে 2010 সালে প্রায় কুড়ি লক্ষ হেক্টর জমিতে অল্প বা একেবারেই চাষ হয়নি । সঙ্কট তীব্র থেকে তীব্রতর হতে চলেছে।
অপচয় রোধ
বিজ্ঞানীরা জলের অপচয় রোধের বিষয় চিন্তা ভাবনা করছেন। তাদের ধারণা জল অপচয় রোধ সম্ভব । সর্বাপেক্ষা বেশি জল যেহেতু কৃষিক্ষেত্রে হয়, তাই প্রথমেই যদি কৃষি ক্ষেত্রে অপচয় বন্ধ করা যায় তবে কিছুটা জলের সাশ্রয় হবে। জল নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের বিজ্ঞানীদের মতে কৃষিকার্যে কতটা জল কিভাবে ব্যবহার করা হবে সেটা যদি ঠিকমতো খেয়াল রাখা যায়, তবে জলের অপচয় অনেকটাই কমানো সম্ভব। আগে কৃষিক্ষেত্রে সেচের জল যেমন তেমন ভাবে দেওয়া হতো, যেমন কোন নালার সাহায্যে না জল দিয়ে গভীর নলকূপ থেকে সরাসরি (জমি ভেজানো পদ্ধতিতে) চাষের জমিতে জল দেয়া হতো। অর্থাৎ একটি জমি পুরোপুরি জলে ভর্তি হবার পর পাশের জমিতে জল যেত। এই পদ্ধতি প্রবর্তনে জল সাশ্রয় সম্ভব । গরমকালে জলের স্তর ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক নীচে নেমে যায়। তাই যে ফসল চাষের জন্য বেশি জলের প্রয়োজন, সে সমস্ত ফসল চাষ না করে, যে সমস্ত ফসল চাষে কম জল লাগে, সেগুলো চাষ করা উচিত। এতে জল সাশ্রয় হবে । ব্যবহারের ক্ষেত্রেও আমরা জল অপচয় না করার বিষয়ে সতর্ক হই তাতেও অনেক জল বাঁচানো যায়। জল অপচয় বিষয়ে আমাদের সচেতনতা প্রয়োজন। প্রয়োজন সংযমী সহাবস্থানের।
জল সংরক্ষণ
জল সংরক্ষণ কিভাবে করা যায় বিজ্ঞানীরা তার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন । জল সংরক্ষণের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রচলন চাই। জল নিয়ে চেতনা আমাদের মধ্যে চেতনা এখনো জেগে ওঠেনি। আমাদের আরেকটি সর্বনাশ ডেকে আনছে যথেচ্ছভাবে বৃক্ষ ছেদন বন্ধ করতে হবে। নতুন করে প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষ রোপণ করতে হবে। বাড়ির ছাদের নিচে জলাধার বানিয়েও বৃষ্টির জল ধরে রাখা যেতে পারে। জল সংরক্ষণের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ করতে হবে। এভাবে অনেক জল সংরক্ষণ সম্ভব।
উপসংহার
অবহেলা নয়, এখনও যদি আমরা সতর্ক না হয় তবে ভবিষ্যতে বিরাট বিরাট জাহাজ পাঠাতে হবে মেরু প্রদেশে বরফ আনার জন্য। দাঁত থাকতে আমরা যেমন দাঁতের মর্যাদা বুঝি না, তেমনি জল থাকতে জলের মর্ম বুঝতে পারছিনা। জীবনের সংকট মেটায় যে জল, সে জলই এখন সঙ্কটে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যদি কখনো বাঁধে, তা জমি বা এলাকার দখল নিয়ে নয়, জল সম্পদের অধিকার নিয়ে বাঁধবে। ইতিমধ্যে ইরাক ও ইরানের মধ্যে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর উপসাগরমুখী সঙ্গমে সাত-এএল-আরবের জলের অধিকার নিয়ে দশ বছর ব্যাপী যুদ্ধ ঘটে গেল। ভারতবাসী সাবধানে।
0 thoughts on “জল সংকট ও সংরক্ষণ”
Nice Writing. Keep it on.