ভূমিকা
বিশাল এ পৃথিবীর জীবজগতের অসীম অনন্ত রহস্যেপূর্ণ। কত রকমের জীব যে এ জগতে আছে তা বলে বোঝানো যথার্থ কঠিন। তবে খেদের কথা, মূলত মানুষেরই স্বার্থপরতা অবহেলা ও অপরিণাম দর্শিতার জন্যে বহু আকর্ষণীয় জীব এরই মধ্যে পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অনেকে আবার বিলুপ্তির মুখোমুখি। বহু জীবের এই বিপদ সম্ভাবনার কথা ভেবেই পৃথিবীর দেশে দেশে আজ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ব্যবস্থা। এ ব্যাপারে আমাদের ভারতে ও খুব একটা পিছিয়ে নেই।
জীবের বিলুপ্তি ও বিলোপ সম্ভাবনা
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে অন্তত ১৩৪ রকমের পাখি ও স্তন্যপায়ী জীব পৃথিবী থেকে চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ডোডো পাখি বা প্যাসেঞ্জার পায়রার মতো প্রাণীদের কোনদিনই আর দেখা যাবে না। সম্প্রতি বাঘরাও বিপদে। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার সম্ভাবনা ক্রমেই তাদের ক্ষেত্রে বাড়ছে। এছাড়া, এখন থেকে সতর্ক না হলে এক শৃঙ্গ গন্ডার ও নির্মল হতে আর বিলম্ব নেই।
নানান বিপদ
বিশেষ কতগুলো কারণেই জীবজগতে আজ এই বিপদ। কতগুলো প্রাণী ধ্বংস হতে চলেছে বেহিসেবি শিকারের জন্যে। যেমন, ভারতে গন্ডার হত্যা করা হয় তার খড়গ এর জন্যে, হাতি শিকার করা হয় মূল্যবান দাঁতের জন্যে, কুমীর নিধন চলে তার মূল্যবান চামড়া বিক্রি করে লাভবান হবার আশায়। কীটপতঙ্গ হত্যা করার জন্যে মানুষ যে সব বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে তা থেকেও বহু প্রাণীর মৃত্যু হয়। বিশেষ করে সে সব প্রাণীরই বিপদ দেখা দেয় যারা ঐ কীট পতঙ্গ খেয়ে বেঁচে থাকে। অবশ্য বেশিরভাগ জীবের বিপদ আসে স্থানাভাব সমস্যা থেকে। জনস্ফতির জন্যে ভারতের শুধু নয়, সারা পৃথিবীতেই অরণ্য অঞ্চল ক্রমে সংকুচিত হচ্ছে। মানুষ ক্রমে বেশি পরিমাণ জায়গা কাজে লাগাচ্ছে শহরও জনবসতি গড়ে তুলতে, রাস্তা নির্মাণে এবং খামার গড়ায়। এইসব ক্রমবর্ধমান চাহিদা অরণ্যবাসী বহু জীবের অস্তিত্ব কে বিপন্ন করে তুলছে। আমাদের ভারতের মতো অর্ধোন্নত বা অনুন্নত দেশের সঙ্গে আবার যুক্ত হচ্ছে প্রধানতঃ জ্বালানীর প্রয়োজনে নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস করার প্রবণতা।
সমস্যার সমাধান
ভারতের মতো দেশে আইন করে লুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণী শিকার বন্ধ করলেই শুধু চলবে না, দেখতে হবে, ওই সব প্রাণী বা তাদের দেহের কোন অংশ বিদেশে রপ্তানি করা না হয়। ভারতের লুপ্তপ্রায় কোন প্রাণী আমদানি করা বা সেই সব প্রাণীর দেহের কোন অংশ ক্রয় করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। এ ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা এগিয়েছে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে সেখানকার সরকার লুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণী আইন প্রণয়ন করে। সেই আইনে স্পষ্ট করেই উল্লেখিত, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে এমন কোন প্রাণী বা তাদের দেহের কোন অংশ বিশেষ করে ক্রয় করা চলবে না। বস্তুত, যতদিন না পৃথিবীর সব দেশেই বিলুপ্ত হয়ে যাবার সম্ভাবনা যুক্ত প্রাণীদের কেনাবেচা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে ততদিন আসল বিপদ কাটাবার কোন আশা নেই। আশার কথা, বিজ্ঞানীরা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের সাহায্য করছেন। ভারতেও রেডিও সিগন্যাল ইত্যাদির সাহায্যে জীবজন্তুদের গতিবিধি জানবার ব্যবস্থা হচ্ছে। এছাড়া, বিভিন্ন চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের সাহায্য নিয়ে এদেশেও চলছে লুপ্তপ্রায় প্রজাতির জীবদের অস্তিত্ব রক্ষার ব্যবস্থা। সম্প্রতি ভারতে কয়েকটি অভায়ারণ্য গড়ে উঠেছে জীবজন্তুদের সহজ ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রার সুযোগ দিতে।
জাতীয় উদ্যান ও অভয়ারণ্য
ভারতের জাতীয় উদ্যান গুলির মধ্যে প্রথমে উল্লেখযোগ্য উত্তরপ্রদেশের করবেট ন্যাশনাল পার্ক। এটিই ভারতের সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে পুরনো এবং সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ ন্যাশন্যাল পার্ক। এর আয়তন ৫২৫.৮০ বর্গ মিলিমিটার। নৈনিতাল জেলায় পড়েছে এর খানিকটা। অবশিষ্ট অংশ পড়েছে টেহরী- গাড়ওয়াল জেলায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ১২০০ থেকে ৪০০০ ফুট ।এখানে বাঘ, হাতি, নেকড়ে বুনো শুয়োর, চিতল, হরিণ ইত্যাদি নানা ধরনের জীব জন্তু আছে। এ অঞ্চলে বাঘ সম্পর্কে বিখ্যাত শিকারী ও লেখকে জিম কর্বেট তাঁর ‘নন ইটারস্ অব কুমায়ুন’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ভারতে যদি বাঘ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তবে তার সবচেয়ে সুন্দর জীবটি হারিয়ে খুবই দরিদ্র হয়ে যাবে’। বাঘের আর একটি বিখ্যাত বিচরণক্ষেত্র মধ্যপ্রদেশের ‘কানহা’। বাঘ ছাড়া এখানকার প্রধান সংরক্ষিত জীব বড় শিং হরিণ। মধ্যপ্রদেশের আরেকটি বিখ্যাত জাতীয় পার্ক শিবপুরি। গুজরাটের গির অরণ্যে খ্যাতি সিংহ সংরক্ষণের জন্যে। ভারতের একমাত্র এই অরণ্যেই সিংহ দেখা যায়। এটি একটি বিখ্যাত অভয়ারণ্য।দক্ষিণ ভারতের অভয়ারণ্যের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য উটকামণ্ডের অনতিদূরে মহীশূর রোডে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত ‘মুদুমালাই’ ও কেরলের ‘পেরিয়ার’। মুদুমালাই অভয়ারণ্যে হাতি, হরিণ,ও বাঘ দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন অঞ্চল ‘রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার’এর জন্যে প্রসিদ্ধ। এগুলো ছাড়া আরও কয়েকটি অভায়ারণ্য ভারতে আছে। এদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ওড়িশার সিমলিপাল, কর্নাটকের বন্দিপুর ইত্যাদি। এছাড়া, হাজারীবাগ ও দুধওয়ার ন্যাশানাল পার্ক দুটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
উপসংহার
ভারতে মোট ৫৩ টি ন্যাশনাল পার্ক ও ২৪৭টি অভায়ারণ্য বা স্যাংচুয়ারি আছে। সারা দেশের ৯০,০০০ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে এরা বিস্তৃত। ভারতের মোট বনাঞ্চলে শতকরা ১২ ভাগ এদের আওতাভুক্ত। কিন্তু তবু এমন কথা বলা যায়না, জাতীয় উদ্যান বা অভায়ারণ্য বিরল বা লুপ্তপ্রায় ধরনের জীবরা নিশ্চিন্ত। লোভী চোরা শিকারির দল শিং,দাঁত বা চামড়ার লোভে প্রায়ই হত্যা করে। এদিকে দোষীরা ধরা পড়েছে বা কার ও কোনরকম দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে, এমন কথা বড়ো একটা শোনা যায় না।