ভূমিকা
বিদ্যালয় জীবনে কথা উঠলেই টুকরো টুকরো স্মৃতির অজস্ব বর্ণালী— মেঘ মনের আকাশে ভিড় করে। কোনটা আশা- আনন্দের আলোয় উজ্জ্বল, কোন টা অসাফল্য নৈরাশ্যের কালিমায় বিবর্ণ, কোনটা বা দুঃখ বেদনা শ্রিত অশ্রুভারে সজল কালো। আজ স্কুল জীবনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছোট্ট একটি স্মৃতি আর সকলকে ছাপিয়ে বারবার মনের পটে জীবন্ত ছবির মতো ফুটে উঠছে– তা বড় দুঃখের,গভীর বেদনার। আজ সেই স্মৃতিকথাই শোনাবো।
বিজ্ঞপ্তি
আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। সবে নতুন বছরের নতুন ক্লাস শুরু হয়েছে ।মালি রাম শরণ লালখাতা হাতে ক্লাসে ঢুকলো। এই লাল খাতা আমাদের অত্যন্ত পরিচিত ও অতি প্রিয়। রামশরনের হাতে এই খাতা দেখলেই আমরা জানি ছুটির নোটিশ আসছে। ইংরেজি নোটিশের সহজ বাংলা করে মাস্টারমশায় জানালেন স্কুলের মাঠে মজাদার খেলা দেখানো হবে, সেজন্য চতুর্থ ঘন্টার পর স্কুলের ছুটি। আমরা যেন আনন্দে উল্লাসে ফেটে পড়লাম।
মজাদার ম্যাজিক
চতুর্থ ঘন্টার সমাপ্তিবেল বাজতেই আমরা খেলার মাঠে হাজির হলাম। মাস্টারমশায়েরা একপাশে চেয়ারে বসেছেন। আমরা মখমলের মতো নরম সবুজ ঘাসের উপর বসেছি। দলে বুড়ো, বুড়ি, একটি যুবক, একটি ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে মোট পাঁচ জন। এরা খেলা দেখাবে। বুড়োর কাছ থেকে ডুগডুগি নিয়ে বুড়ি বাজাতে লাগল। বুড়ো ম্যাজিক স্টিক এর মত একটি স্টিক হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই, ডুগডুগি বাজানা গেল থেমে। বুড়ো ছেঁড়া বিবর্ণ কোটের পকেট থেকে বের করল একটি রঙিন রুমাল। স্টিকের মাথায় রুমালটা নাড়তে নাড়তে একসময় অদৃশ্য করে দিল। বলল– আমাদের দর্শকদের কারোর না কারোর পকেট থেকে রুমাল খানা বেরোবে। অবশেষে বেরোলো পন্ডিত মশায়ের পকেট থেকে। পন্ডিত মশাই এর মত খুঁতখুঁতে মানুষের পকেট থেকে বেরোতে আমাদের ফুর্তি যেন দ্বিগুন হলো। এমনই করে বুড়ো জাদুর হরবা ছড়াতে লাগলো মুহুর্মুহু।
হঠাৎ আবার ডুগডুগি বাজতে আমরা যেন সম্বিত ফিরে পেলাম। কোথা থেকে এলো এত বড় দুটো ময়ূর। ময়ূরের মতো অবিকল মাথা, ঠোঁট, পেখম –তেমনি ঊর্ধ্বপুচ্ছ হয়ে ঘুরে ঘুরে চরে বেড়াচ্ছে। আসলে ছোট ছেলে -মেয়ে দুটি ময়ূরের পোশাক পড়ে দুই হাতের উপর ভর দিয়ে মাথা নিচু করে পা উপরে তুলে ময়ূর হয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। আমরা হাততালি দিয়ে হৈ-চৈ করতে লাগলাম। ময়ূরের গতি ভঙ্গির নানা কলাকৌশল ওরা দেখাতে লাগলো। ওরা এক সময় মুখোমুখি হয়ে যুদ্ধের অভিনয় করলো। মনে পড়ল মাস্টারমশায় আমাদের মজাদার খেলার কথা বলেছিলেন, তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। সত্যিই অপূর্ব মজাদার, অত্যন্ত সেই কিশোর বয়সে এমন মজাদার খেলা দেখিনি।
বাঁশবাজি
আবার ডুগডুগি বাজতেই দেখি দৃশ্যপটের পরিবর্তন হয়েছে। যুবক ছেলেটি 10-12 হাত লম্বা একখণ্ড বাঁশ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। ময়ূরের পোশাক ছেড়ে ছোট্ট ছেলে মেয়ে দুটি যুবকের পাশের দণ্ডায়মান। কে যেন চেঁচিয়ে উঠল বাঁশবাজি হবে। বাঁশবাজি? মনটা নেচে উঠলো। ঠাকুমার কাছে গল্প শুনেছি আমাদের বুড়ো শিবের থানে চৈত্রগাজনে নাকি বাঁশ বাজি হত।
বিপর্যয়
আবার ডুগডুগি বাজতেই দেখি দৃশ্যপটের পরিবর্তন হয়েছে । যুবক ছেলেটি কোমরে গামছা বাঁধছে। ওই বাঁধা গামছায় যুবকটি বাঁশটিকে খাড়া করে দাঁড় করিয়েছে আর সেই বাঁশের মাথায় চড়ে ছোট্ট ছেলেটা খেলা দেখাচ্ছে। কত কলাকৌশল, কত কসরতই না দেখাচ্ছে। মুহুর্মুহু পড়ছে হাততালি আর দ্রুত তালে বাড়ছে ডুগডুগি। এত উল্লাস, এত আনন্দের মধ্যে একসময় হায় হায় আত্মধ্বনির মধ্যে সকলের কন্ঠ হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। বাঁশের মাথার উপর থেকে নিত্য চপল ছেলেটি পড়ে গেছে মাটির উপর। কয়েকবার হাত-পা- ছুড়ে চিরদিনের মত স্তব্ধ হয়ে গেল সে। তার মুখ- নাক থেকে তখনও ঝড়ছে রক্তের স্রোত। লাল চাপ চাপ রক্ত। যেন ফুটন্ত রক্ত গোলাপের একরাশ পাপড়ি।
উপসংহার
আসন্ন সন্ধ্যায় আমরা যখন বাড়ি ফিরছিলাম কনকনে হিমেল বাতাসে হাত পা যেন ঠান্ডায় জমে পাথর হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ওদিকে বড় একটা খেয়াল ছিল না। কানে তখনও আসছিল সদ্য সন্তানহারা জনক-জননীর আত্ম ক্রন্দন। তারপর সুখ-দুঃখের কত স্মৃতিই না মনের মনিকোঠায় জমেছে, কিন্তু স্কুলজীবনের অশ্রুস্নাত স্মৃতিটুকু আর সকলের উর্ধ্বে ধ্রুবতারার মত অনির্বাণ ও অম্লান হয়ে আছে।